ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিটকয়েন এর নাম শুনলেই আমাদের মনে যে প্রযুক্তিটির কথা আসে তা হচ্ছে ব্লকচেইন । আমাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই মনে করেন এই প্রযুক্তিটি শুধুমাত্র ডিজিটাল মুদ্রা আদান-প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর প্রয়োগের পরিধি অত্যন্ত বিশাল। আপনার ব্যক্তিগত জমির দলিল এর নিরাপত্তা বৃদ্ধি থেকে শুরু করে অত্যন্ত জটিল ডেটাবেস প্রক্রিয়াকরনের কাজসহ আরো বহুমুখী সমস্যার সমাধান খুব সহজেই করা যায় এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে। তাই আজকের এই নিবন্ধে আমরা জানবো ব্লকচেইন প্রযুক্তি কী এবং কিভাবে এটি আপনার জমির দলিল থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য রেকর্ড পর্যন্ত সবকিছু সুরক্ষিত করতে পারে।
ব্লকচেইন কী এবং কেন এটি ‘অপরিবর্তনীয়’?
ব্লকচেইন হলো একটি বিকেন্দ্রীভূত তথ্যভাণ্ডার অর্থাৎ এটি কোনো একক ব্যক্তি, সংস্থা বা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। আপনারা ব্লক চেইনের নাম শুনেই হয়তো অনেকটা আন্দাজ করতে পারছেন যে এর কাজ কি। এই প্রযুক্তিতে মূলত তথ্যকে ‘ব্লক’ আকারে সংরক্ষণ করা হয় এবং এই ব্লকগুলো একটির পর একটি চেইনের মতো যুক্ত থাকে ঠিক যেমনভাবে একটি লোহার ছোট চেইন পর্যায়ক্রমে আরেকটি চেইনের সাথে যুক্ত থাকে।
১. ব্লক : প্রতিটি ব্লকে কিছু লেনদেনের তথ্য অথবা অন্য কোনো ডিজিটাল তথ্য জমা থাকে। ধরুন, আপনি কাউকে ১০০০ টাকা পাঠালেন—এই তথ্যটি একটি ব্লক।
২. চেইন : একটি ব্লক সম্পূর্ণ হওয়ার পর সেটি ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশিং নামক এক জটিল গাণিতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুরক্ষিত হয় এবং আগের ব্লকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এভাবে একটি দীর্ঘ চেইন তৈরি হয়।
৩. বিকেন্দ্রীভূত : এর অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এই তথ্যগুলো কোনো একটি নির্দিষ্ট সার্ভারে জমা থাকে না। বরং, একই তথ্যের কপি বিশ্বের হাজার হাজার কম্পিউটারে বা নোডে ছড়িয়ে থাকে।
কেন এটি অপরিবর্তনীয়?
যদি কেউ এই চেইনের একটি তথ্য বা ব্লক পরিবর্তন করতে চায়, তবে তাকে একই সঙ্গে হাজার হাজার কম্পিউটারে থাকা সেই ব্লকের প্রত্যেকটা কপি পরিবর্তন করতে হবে, এবং ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশ নামক জটিল গাণিতিক কোডটি পুনরায় তৈরি করতে হবে। যা প্রায় অসম্ভব। এই কারণেই ব্লকচেইনে একবার কোনো তথ্য লিপিবদ্ধ হলে তা চিরতরে অপরিবর্তিত থাকে।
এখন আপনাদের মধ্যে প্রশ্ন জাগতে পারে,
কিভাবে এই ব্লকচেইন প্রযুক্তি আমাদের জমির দলিলের নিরাপত্তা ও অন্যান্য ব্যক্তিগত কাজে আসতে পারে?
চলুন এর উত্তর দেওয়া যাক। যেহেতু ব্লকচেইন এ থাকা ডেটা অপরিবর্তনীয়, বিকেন্দ্রীভূত ও তৃতীয় পক্ষের প্রভাবমুক্ত, সেহেতু এটি সর্বোচ্চ বিশ্বস্ততা নিশ্চিত করে, তাই ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন খাতে এর ব্যবহার বিপুল পরিবর্তন আনতে পারে:
ভূমি রেকর্ড ও দলিলপত্র: বাংলাদেশে জমির মালিকানা সংক্রান্ত বিতর্ক ও দলিল জালিয়াতি একটি বড় সমস্যা। আপনি অথবা আপনার কোনো নিকটাত্মীয় হয়তো কোনো না কোনো ভাবে এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। ব্লক চেইন হতে পারে এই সমস্যার সেরা একটি সমাধান । কেনোনা ব্লকচেইনে একবার জমির মালিকানার তথ্য ও দলিলপত্র সুরক্ষিতভাবে লিপিবদ্ধ হলে, তা জাল করা ও অবৈধ ভাবে পরিবর্তন করা অসম্ভব । এতে ভূমি সংক্রান্ত দুর্নীতি নিরসন সহ আপনার দলিলের নিরাপত্তা হবে অকাট্য।
স্বাস্থ্যসেবা ও মেডিকেল রেকর্ড: ব্লকচেইন ব্যবহার করে রোগীর স্বাস্থ্য রেকর্ড সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এতে প্রেসক্রিপশন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট ইত্যাদি সুরক্ষিত থাকবে এবং যে কোনো হাসপাতাল বা ডাক্তার তাৎক্ষণিক ও নির্ভুলভাবে রোগীর তথ্য যাচাই করতে পারবেন।
ভোটিং সিস্টেম: ব্লকচেইন ভিত্তিক ভোটিং সিস্টেম তৈরি করা সম্ভব, যা ভোটের স্বচ্ছতা ও নির্ভুলতা নিশ্চিত করবে। একবার ভোট দেওয়ার পর তা পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না এবং পুরো প্রক্রিয়াটি সবার কাছে স্বচ্ছ থাকবে।
সাপ্লাই চেইন : কোনো পণ্য (যেমন: ওষুধ, খাদ্য বা পোশাক) কোথা থেকে আসছে, কীভাবে প্রক্রিয়াজাত হয়েছে—এই পুরো যাত্রাপথ এর তথ্যগুলো ব্লকচেইনের মাধ্যমে ট্র্যাক করা সম্ভব। এতে খাদ্যে ভেজাল বা পণ্যের মান নিয়ে সন্দেহ দূর হবে।
এগুলো ছাড়াও ব্লক চেইনের রয়েছে আরও নানাবিধ ব্যবহার।
সুতরাং ব্লকচেইন শুধুমাত্র একটি টেকনিক্যাল ধারণা নয়, এটি হলো ডিজিটাল জগতে বিশ্বাস তৈরির একটি নতুন কাঠামো। আমাদের বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের জন্য, যেখানে স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তার অভাব প্রকট, সেখানে ব্লকচেইন হতে পারে এক কার্যকর সমাধান।
MD. ALIM
Independent Researcher
Govt MM Ali College
Leave a comment