সম্পাদকীয়

সীমান্ত পেরিয়ে বিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত

Share
Share

ড. মশিউর রহমান

আধুনিক গবেষণার জগতে একটি বিষয় দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে—এককভাবে কোনো শাখা আর সমাজের জটিল সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারছে না। জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে নতুন রোগের চিকিৎসা কিংবা টেকসই জ্বালানি—সবখানেই দেখা যাচ্ছে একক শাখার সীমাবদ্ধতা। তাই এখন দরকার বহুমাত্রিক জ্ঞানকে একত্রিত করে নতুন পথের সন্ধান করা। জাপানের সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এজেন্সি সম্প্রতি যে আলোচনা আয়োজন করেছিল, তার মূল প্রতিপাদ্য ছিল এই বহুবিষয়ক আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বাস্তব অভিজ্ঞতা।

প্রথম বক্তা প্রফেসর নানবা তাঁর অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন ব্যাকটেরিয়ার মাইক্রো-প্রপেলার মোটর নিয়ে। এটি এমন এক জীববৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা, যা চোখে দেখা যায় না, অথচ এক সেকেন্ডে কয়েকশ বার ঘুরে ব্যাকটেরিয়াকে গতিশীল রাখে। এই রহস্যময় মোটরকে উন্মোচন করতে তিনি একা ছিলেন না—অক্সফোর্ড ও সিডনির গবেষকদের সঙ্গে মিলেই শুরু করেছিলেন কাজ। ভিন্ন ভিন্ন শাখার জ্ঞান—ডিএনএ অরিগামি প্রযুক্তি, এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি, ক্রায়ো-ইলেকট্রন মাইক্রোস্কপি—সবকিছু মিলেমিশে এক অনন্য বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা তৈরি করেছিল। প্রফেসর নানবার বক্তব্যে বোঝা গেল, শুধু গবেষণাগারেই নয়, বরং সম্মেলন, খাবার টেবিল, কিংবা স্কি-রিসোর্টের আলোচনার টেবিলেই অনেক নতুন ধারণার জন্ম হয়। সীমান্ত ছাড়িয়ে কাজ করার এটাই আসল সৌন্দর্য।

পরের বক্তা প্রফেসর কাকুগো এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা শোনালেন। তিনি গবেষণা করেন “কৃত্রিম ঝাঁক”—যেখানে রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে জীবজগতের মাছ বা পাখির ঝাঁকের আচরণ অনুকরণ করা হয়। তাঁর কৌতূহল শুরু হয়েছিল প্রাকৃতিক জগতের ঝাঁকের সৌন্দর্য দেখে: কেন জীবেরা ঝাঁক বাঁধে? এর সুবিধা কী? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন থেকে শুরু করে বায়োমেডিসিন পর্যন্ত নানা শাখার গবেষকদের সাথে হাত মেলালেন। নিউইয়র্ক, ইসরায়েল, ইতালির ল্যাব ঘুরে তিনি আবিষ্কার করলেন, সহযোগিতার মূল শক্তি তৈরি হয় অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতা থেকে। কফি বিরতিতে শুরু হওয়া কথোপকথন কখনো কখনো আন্তর্জাতিক প্রকল্পে রূপ নেয়। এমনকি হাসপাতালের বেড থেকে ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নিয়েও তিনি তাঁর সহযোগিতা এগিয়ে নিয়েছিলেন—যা প্রমাণ করে বৈজ্ঞানিক কৌতূহলকে দমিয়ে রাখা যায় না।

এই অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের একটি মৌলিক সত্য মনে করিয়ে দেয়—বিজ্ঞান শুধু ল্যাবরেটরির ভেতর সীমাবদ্ধ নয়। এটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক অভিজ্ঞতার সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা মানে কেবল গবেষণাপত্র ভাগাভাগি করা নয়, বরং ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে আসা মানুষের সাথে মিলে নতুন ভাষা শেখা, ভুল বোঝাবুঝি কাটিয়ে ওঠা, এবং ধৈর্য ধরে আলোচনায় অংশ নেওয়া। অনেক সময় ভাষাগত সীমাবদ্ধতা কিংবা ভিন্ন গবেষণা সংস্কৃতি শুরুতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু প্রকৃত আগ্রহ ও পারস্পরিক সম্মান সেই বাধা ভেঙে দেয়।

বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এই অভিজ্ঞতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের তরুণ গবেষকরা প্রায়ই প্রশ্ন করেন—আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কীভাবে শুরু করা যায়? উত্তরটি সহজ: সুযোগের অপেক্ষা না করে এগিয়ে যেতে হবে। ছোট কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করা, অনলাইনে আলোচনায় যুক্ত হওয়া, কিংবা বিদেশি গবেষকের সাথে এক কাপ কফি ভাগ করে নেওয়াও হতে পারে এক নতুন যাত্রার সূচনা। যে সাহসী পদক্ষেপ আজ ছোট মনে হচ্ছে, সেটাই হয়তো কালকে হয়ে উঠবে যুগান্তকারী কোনো আবিষ্কারের ভিত্তি।

গ্লোবাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার এই সময়ে বাংলাদেশি গবেষকদের সামনে বিরাট সুযোগ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, জনস্বাস্থ্য, কৃষি কিংবা তথ্যপ্রযুক্তি—সবখানেই আন্তঃবিষয়ক আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সম্ভাবনা অপরিসীম। তবে এর জন্য প্রয়োজন মুক্ত মানসিকতা, সীমান্তের বাইরে তাকানোর দৃষ্টি, এবং সহযোগিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা। গবেষণার কূটনীতি মানে শুধু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নীতি নয়; প্রতিটি গবেষকের ব্যক্তিগত পদক্ষেপও এই কূটনীতির অংশ।

বিজ্ঞানকে যদি সত্যিই সমাজ পরিবর্তনের শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তবে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে শুধু গবেষণায় নয়, সম্পর্ক গড়ায়ও দক্ষ হতে হবে। সীমান্তের ভেতরে আটকে থাকা নয়—সীমান্ত পেরিয়ে হাত বাড়াতে হবে, কারণ আগামী দিনের বিজ্ঞান হবে সবার যৌথ প্রচেষ্টার ফল।


সূত্র:
Japan Science and Technology Agency এর একটি অনুষ্ঠানের বক্তব্য থেকে লেখাটি লিখিত

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org