এসো শিখিরসায়নবিদ্যা

রসায়ন (Chemistry): বিভাগ, বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহার

Share
Share

রসায়ন এমন একটি বিজ্ঞান যা পদার্থের গঠন, গুণ, পরিবর্তন ও পারস্পরিক বিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করে। এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের সাথে জড়িত—খাবার রান্না থেকে শুরু করে ওষুধ তৈরি, কৃষি, শিল্প, এমনকি মহাকাশ গবেষণাতেও রসায়নের ভূমিকা অপরিসীম।

রসায়ন মূলত কয়েকটি প্রধান শাখায় বিভক্ত, প্রতিটি শাখা পদার্থের নির্দিষ্ট দিক ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করে। নিচে আপনি রসায়নের প্রধান বিভাগগুলো এবং তাদের ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

🔹 ১. অজৈব রসায়ন (Inorganic Chemistry)

অজৈব রসায়ন হলো এমন পদার্থের রসায়ন যা মূলত কার্বন ছাড়া অন্যান্য মৌল ও যৌগ নিয়ে কাজ করে। যেমন—ধাতু, অধাতু, লবণ, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি।

আপনি এখানে শিখবেন:
মৌল ও যৌগের গঠন
লবণ, অ্যাসিড ও ক্ষারের বিক্রিয়া
ধাতব সংকর (alloys) ও খনিজ পদার্থের গঠন

ব্যবহার:
শিল্পক্ষেত্রে: সিমেন্ট, কাচ, ধাতব যন্ত্রপাতি, সার ইত্যাদি উৎপাদনে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে: ওষুধে ব্যবহৃত কিছু যৌগ যেমন FeSO₄ (Iron supplement), Mg(OH)₂ (antacid) ইত্যাদি।
পরিবেশ বিজ্ঞানে: পানির বিশুদ্ধতা, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়।

অজৈব রসায়ন হচ্ছে মৌলিক রসায়নের ভিত্তি। আপনি যদি রসায়নের গঠনগত দিক ভালোভাবে বুঝতে চান, এই অংশে দক্ষতা অপরিহার্য।

🔹 ২. জৈব রসায়ন (Organic Chemistry)

জৈব রসায়ন মূলত কার্বনভিত্তিক যৌগ নিয়ে কাজ করে। কার্বন অন্য মৌলের সাথে যুক্ত হয়ে বিপুল সংখ্যক যৌগ গঠন করতে পারে—এই বৈচিত্র্যের কারণেই জৈব রসায়ন এত বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ।

আপনি এখানে শিখবেন:
হাইড্রোকার্বন, অ্যালকোহল, অ্যাসিড, ইস্টার, অ্যালডিহাইড, কিটোন প্রভৃতি যৌগের গঠন ও বিক্রিয়া
বায়োমলিকিউল (প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, লিপিড ইত্যাদি)
পলিমার (প্লাস্টিক, নাইলন, পলিথিন ইত্যাদি)

ব্যবহার:
ওষুধশিল্পে: প্রায় সব ধরনের ওষুধ, ভিটামিন, এনজাইম—সবই জৈব যৌগ।
পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পে: পেট্রোল, ডিজেল, প্লাস্টিক, রাবার, রঙ ইত্যাদি তৈরি হয়।
কৃষিক্ষেত্রে: কীটনাশক, সার, উদ্ভিদবর্ধক হরমোন সবই জৈব রসায়নের ফলাফল।

জৈব রসায়নকে জীবনের রসায়ন বলা হয়, কারণ জীবিত প্রাণীর দেহে সংঘটিত প্রায় প্রতিটি রাসায়নিক বিক্রিয়া জৈব যৌগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

🔹 ৩. ভৌত রসায়ন (Physical Chemistry)

ভৌত রসায়ন রসায়নের এমন একটি শাখা যেখানে পদার্থের ভৌত গুণাবলি এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতিবিদ্যা ও তাপগতিবিদ্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়।

আপনি এখানে শিখবেন:
রাসায়নিক তাপগতিবিদ্যা (Thermodynamics)
বিক্রিয়ার হার ও গতি (Chemical Kinetics)
পরমাণুর গঠন ও কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রি
ইলেক্ট্রোরসায়ন (Electrochemistry)

ব্যবহার:
শিল্প উৎপাদনে: বিক্রিয়ার দক্ষতা বাড়াতে তাপমাত্রা, চাপ, অনুঘটক (Catalyst) ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
পরিবেশ ও শক্তি: ব্যাটারি, সোলার সেল, ফুয়েল সেল তৈরিতে ভৌত রসায়নের ভূমিকা অপরিসীম।
গবেষণায়: নতুন পদার্থ বা বিক্রিয়ার প্রক্রিয়া বোঝার জন্য এটি অপরিহার্য।

ভৌত রসায়নকে রসায়নের “গণিতভিত্তিক অংশ” বলা হয়। আপনি যদি বিজ্ঞানী হতে চান, এই অংশের জ্ঞান আপনাকে বিশ্লেষণী চিন্তাশক্তি বাড়াতে সাহায্য করবে।

🔹 ৪. বিশ্লেষণাত্মক রসায়ন (Analytical Chemistry)

এটি এমন একটি শাখা যেখানে পদার্থের গঠন, পরিমাণ ও বিশুদ্ধতা নির্ধারণ করা হয়।

আপনি এখানে শিখবেন:
গুণগত বিশ্লেষণ (Qualitative Analysis): কোন পদার্থে কী আছে তা জানা।
পরিমাণগত বিশ্লেষণ (Quantitative Analysis): কত পরিমাণ আছে তা নির্ণয় করা।
যন্ত্র বিশ্লেষণ (Instrumental Analysis): যেমন — Spectroscopy, Chromatography, Titration ইত্যাদি।

ব্যবহার:
ওষুধ ও খাদ্য মান নিয়ন্ত্রণে: কোনো পণ্যে ক্ষতিকর পদার্থ আছে কিনা তা নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়।
গবেষণায়: নতুন যৌগ তৈরি হলে তার গঠন ও বিশুদ্ধতা যাচাই করা হয়।
পরিবেশ পর্যবেক্ষণে: পানি, মাটি ও বায়ুতে দূষণ উপাদান পরিমাপে।
যদি আপনি পরীক্ষাগারভিত্তিক কাজ বা রিসার্চ ভালোবাসেন, বিশ্লেষণাত্মক রসায়ন আপনার জন্য আদর্শ ক্ষেত্র।

🔹 ৫. জীবরসায়ন (Biochemistry)

জীবরসায়ন মূলত জীবদেহে সংঘটিত রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলো অধ্যয়ন করে।

আপনি এখানে শিখবেন:
প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, লিপিড ও এনজাইমের কার্যপ্রণালী
ডিএনএ, আরএনএ ও জিনের রসায়ন
বিপাক প্রক্রিয়া (Metabolism)

ব্যবহার:
চিকিৎসা ও জেনেটিক্সে: রোগের কারণ, ওষুধের কার্যপ্রণালী, জিন থেরাপি ইত্যাদিতে।
খাদ্য ও কৃষিক্ষেত্রে: পুষ্টিগুণ বিশ্লেষণ ও জৈব সার তৈরিতে।
বায়োটেকনোলজিতে: নতুন ভ্যাকসিন, বায়োফুয়েল ও জিনগত পরিবর্তনকৃত জীব (GMOs) তৈরিতে।
জীবরসায়ন মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য বোঝার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখাগুলোর একটি।

🔹 রসায়নের সমন্বিত গুরুত্ব

রসায়নের এই পাঁচটি শাখা পরস্পরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। একটির জ্ঞান ছাড়া অন্যটি পূর্ণাঙ্গভাবে বোঝা যায় না। উদাহরণস্বরূপ, একটি নতুন ওষুধ তৈরি করতে জৈব রসায়ন প্রয়োজন, কিন্তু তার গঠন বিশ্লেষণে বিশ্লেষণাত্মক রসায়ন লাগে, কার্যপ্রণালী বোঝার জন্য জীবরসায়ন লাগে, আর উৎপাদনের দক্ষতা বাড়াতে ভৌত রসায়ন ব্যবহৃত হয়।

✅ শেষ কথা

রসায়ন শুধু পরীক্ষাগারে সীমাবদ্ধ নয়—এটি মানুষের জীবন, শিল্প, প্রযুক্তি ও পরিবেশের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আপনি যদি রসায়ন ভালোভাবে শিখতে পারেন, তাহলে বিজ্ঞান, প্রকৌশল, চিকিৎসা, কৃষি—যেকোনো ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারবেন।

রসায়ন শেখা মানে শুধু সূত্র মুখস্থ করা নয়; বরং পদার্থের আচরণ ও প্রকৃতির রহস্য অনুধাবন করা। তাই যদি আপনি পৃথিবীকে গভীরভাবে জানতে চান, রসায়নের প্রতিটি শাখাই আপনাকে নতুন দিগন্তে নিয়ে যাবে।


হোসেন মোঃ আরাফাত 
রসায়ন বিভাগ,চট্টগ্রাম কলেজ।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org