সাধারণ বিজ্ঞানস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

আচরণ থেকে আচরণে, তুমি যেমন, পৃথিবীও তেমন!

Share
Share

ছবিঃ ওয়েব থেকে সংগৃহীত

মানুষের আচরণ কখনো নিছক ব্যক্তিগত কিছু নয়। আমরা প্রতিদিন যেভাবে অন্যদের সঙ্গে কথা বলি, প্রতিক্রিয়া দিই বা নিছক একটুখানি হাসি ভাগ করে নিই সেই সবকিছুই কারও না কারও মানসিক অবস্থা বদলে দেয়, কখনো ক্ষণিকের জন্য, কখনো সারাজীবনের জন্য। ভদ্রতা অনেক সময় শব্দের চেয়েও বড় ভাষা হয়ে ওঠে। একটি বিনম্র ‘ধন্যবাদ’, একটি সংযত বাক্য বা একটিমাত্র শান্ত দৃষ্টিও অন্যের ভেতর এমন এক প্রতিধ্বনি তোলে, যা হয়তো তার দিনের ভার হালকা করে দেয়, কিংবা তার নিজের আচরণেও সেই একই কোমলতা ছড়িয়ে দেয়।

মনোবিজ্ঞানে এটিকে বলে psychological resonance, অর্থাৎ মানসিক প্রতিধ্বনি। আমাদের মস্তিষ্কে কিছু বিশেষ নিউরন আছে, যেগুলোকে বলে mirror neurons এই নিউরনগুলিই আমাদের শেখায় অন্যের আবেগ অনুভব করতে, অন্যের হাসি দেখে হাসতে বা কারও দুঃখ দেখে ব্যথিত হতে। কেউ আমাদের সঙ্গে ভদ্র ও সহানুভূতিশীল আচরণ করলে, এই নিউরনগুলো সক্রিয় হয়, মস্তিষ্কে oxytocin ও serotonin নামের ‘feel-good’ হরমোন নিঃসৃত হয়, যা আমাদের মনে নিরাপত্তা, বিশ্বাস ও প্রশান্তি জাগায়। তখন আমরা নিজের অজান্তেই সেই একই সৌজন্য আবার ফিরিয়ে দিই অন্যের দিকে। অর্থাৎ, ভদ্রতা আসলে একধরনের স্নায়বিক প্রতিধ্বনি, যা এক মস্তিষ্ক থেকে অন্য মস্তিষ্কে নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়ে।

এ কারণে সমাজে সৌজন্যের সংস্কৃতি শুধু নৈতিক বিষয় নয়, এটি বৈজ্ঞানিকভাবেও একটি মানসিক ভারসাম্যের চেইন তৈরি করে। ভাবুন, এক অফিসে বা হাসপাতালে কেউ যদি সবাইকে সম্মান দিয়ে কথা বলে, তার সেই শান্ত ব্যবহার অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। এমন পরিবেশে মানুষ নিরাপদ বোধ করে, নিজের কাজ আরও মনোযোগ দিয়ে করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব কর্মস্থলে পারস্পরিক সম্মান ও নম্রতা বেশি, সেখানে কর্মীদের মানসিক চাপ কম থাকে, এমনকি ‘burnout’ হওয়ার প্রবণতাও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। অর্থাৎ, ভদ্রতা শুধু নৈতিকতা নয়, মানসিক স্বাস্থ্যেরও একটি প্রয়োজনীয় উপাদান।

কিন্তু এ প্রভাবের সৌন্দর্য এখানেই শেষ নয়। কখনো কখনো একটি ছোট্ট ভদ্র আচরণ এমন একজন মানুষের মনে আলো ছড়ায়, যে হয়তো নিজের জীবনে অন্ধকারে ডুবে ছিল। আপনি হয়তো কেবল পথের ধারে বসে থাকা এক বৃদ্ধাকে হাসিমুখে সালাম দিয়েছেন, অথচ তার নিঃসঙ্গ দিনটায় সেটিই হয়ে গেল সবচেয়ে উজ্জ্বল মুহূর্ত। আমরা জানি না, আমাদের ব্যবহার কার জীবনের কোন জায়গায় ছাপ ফেলে যায়, কিংবা আমাদের একটি কথা কারো মানসিক ভার সামলে নেয়।

এই পৃথিবীতে আচরণের প্রতিধ্বনি এক অদৃশ্য সুরের মতো কাজ করে। আপনি যেমন ব্যবহার করেন, সেই ব্যবহারই ধীরে ধীরে আপনার চারপাশের মানুষদের মাধ্যমে আপনাকেই প্রতিফলিত হয়। এ যেন এক মহাজাগতিক আয়না যেখানে আপনার ভদ্রতা ফিরে আসে সৌন্দর্যে, আর আপনার রুক্ষতা ফিরে আসে তিক্ততায়। তাই ভদ্রতা মানে দুর্বলতা নয়; এটি এমন এক নীরব শক্তি, যা পরিবেশ, সম্পর্ক ও মানসিক স্থিতি বদলে দিতে পারে।

আমরা যখন ভদ্র হই, আসলে তখন আমরা শুধু অন্যকে শ্রদ্ধা জানাই না, বরং নিজের মস্তিষ্কেও প্রশান্তির রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া ঘটাই। এটি আত্মাকে হালকা করে, ভাবনাকে স্থির করে এবং চারপাশে এমন এক শান্ত শক্তি ছড়িয়ে দেয়, যা অদৃশ্য হলেও অনুভূত হয়। সেই কারণেই মহান দার্শনিকরা বলেছিলেন, “ভদ্রতা এমন এক ভাষা, যা বোবা শুনতে পারে এবং অন্ধ দেখতে পারে।”

মানবিকতার আসল সৌন্দর্য এখানেই যেখানে আচরণ শুধু আচরণ থাকে না, বরং একে অপরের ভেতর আলো জ্বালায়। আমরা সবাই কারও না কারও প্রতিধ্বনি। তাই ভদ্রতা মানে শুধু সামাজিক শিষ্টাচার নয়; এটি এক প্রকার স্নায়বিক ও আবেগীয় শক্তি, যা মানুষে মানুষে সংযোগ সৃষ্টি করে, অজান্তেই পৃথিবীকে একটু বেশি বাসযোগ্য করে তোলে।

“Be kind whenever possible. It is always possible.”

-দালাই লামা

মানুষের জীবনে সবচেয়ে কঠিন অভ্যাসগুলোর একটি হলো সন্তুষ্ট থাকা। আমরা যা পাই, তার চেয়ে যা পাইনি সেটাই বারবার চোখে পড়ে; ফলে আনন্দের আসল উৎসগুলো আমাদের অগোচরে থেকে যায়। কিন্তু যে মানুষ নিজের প্রাপ্তিতে শান্ত থাকতে পারে, তার ভেতরে এক ধরনের স্থিরতা জন্ম নেয় যা অন্য কোনো অর্জনে পাওয়া যায় না।

সন্তুষ্টি মানে নিষ্ক্রিয়তা নয়। এটি এমন এক মানসিক পরিপক্বতা, যেখানে মানুষ জানে, সব কিছুই তার হাতে নেই, তবু যা আছে, তা যথেষ্ট। এর ভেতর আছে কৃতজ্ঞতার মনোভাব। কৃতজ্ঞ মানুষ আসলে জীবনের প্রতিটি ছোট ঘটনায় সৌন্দর্য খুঁজে নেয় এক কাপ চা, একটি ভোর, কারও আন্তরিক প্রশ্ন “আপনি কেমন আছেন” এসবের ভেতরেই সে শান্তি পায়।

মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, সন্তুষ্ট থাকা এক ধরনের cognitive balance যেখানে মস্তিষ্ক নিজের চাহিদা ও বাস্তবতার মধ্যে একটি সামঞ্জস্য তৈরি করে। এটি dopamine-এর নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, অর্থাৎ ক্রমাগত আরও পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কমিয়ে একধরনের স্থিতিশীল আনন্দ সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা জীবনের ছোট প্রাপ্তিতে সন্তুষ্ট থাকতে শেখে, তাদের মানসিক চাপ কম থাকে, ঘুম ভালো হয়, এমনকি শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়ে যায়।

সন্তুষ্টি আসলে এক ধরনের আচরণও বটে। এটি কথায় প্রকাশ পায় যেমন “ধন্যবাদ”, “ভালো আছি”, “চেষ্টা করছি” এই শব্দগুলো শুধু বাক্য নয়, মানসিক প্রশান্তির বহিঃপ্রকাশ। আবার এটি চেহারায়ও ধরা পড়ে যে মানুষ নিজের অবস্থান নিয়ে অভিযোগ না করে ধৈর্য রাখে, তার মুখে এক ধরনের প্রশান্তি দেখা যায়। সেই প্রশান্তিই আশেপাশের মানুষদেরও ছুঁয়ে যায়।

আজকের পৃথিবীতে আমরা ক্রমাগত তুলনায় বাস করি। অন্যের সাফল্যকে নিজের ব্যর্থতার আয়নায় দেখি, অথচ ভুলে যাইবআমাদের প্রতিটি পথেরই নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। সন্তুষ্ট থাকা মানে নিজেকে ছোট ভাবা নয়; বরং নিজের বর্তমান অবস্থাকে স্বীকার করা, এবং তার ভেতর থেকেই উন্নতির শক্তি খুঁজে পাওয়া।

যা পেয়েছি, তা-ই আসলে প্রাপ্তির শ্রেষ্ঠ রূপ কারণ সেটিই আমাদের জীবনের গল্পের এই মুহূর্তের অংশ। একদিন যা হারাব, সেটিও কোনো না কোনোভাবে আমাদের গড়ে তুলেছে। সন্তুষ্টি তাই শেষ নয়, এটি যাত্রার এক শান্ত বিরতি, যেখানে মানুষ নিজের শ্বাসে, নিজের সীমায়, নিজের সময়েই সৌন্দর্য আবিষ্কার করে।


মো. ইফতেখার হোসেন 
এমবিবিএস ১ম বর্ষ , কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ |
আগ্রহের ক্ষেত্র মূলত আচরণবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান ও অভ্যাসবিজ্ঞান।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org