সম্পাদকীয়

চীনের নতুন স্বপ্ন: নিজের এনভিডিয়া গড়ার পথে

Share
Share

ড. মশিউর রহমান

বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রতিযোগিতার নতুন অধ্যায় এখন এশিয়ার এক প্রান্তে লেখা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বন্দ্ব যতই তীব্র হচ্ছে, চীন ততই বুঝে ফেলছে—কেবল জেনারেটিভ এআই মডেল বানিয়ে বিশ্বকে চমকে দেওয়া যথেষ্ট নয়। এসব মডেল চালাতে যে চিপ দরকার, সেটার উপরও বিদেশি নিয়ন্ত্রণ কমানো জরুরি। এনভিডিয়ার দীর্ঘদিনের আধিপত্য ভাঙতে চাইছে বেইজিং, আর সেই প্রচেষ্টা কেবল অর্থনীতির হিসেবেই নয়, জাতীয় কৌশলের দিক থেকেও গভীর তাৎপর্য বহন করছে।

হঠাৎ করেই এক বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে। খবর এসেছে, এনভিডিয়া চীনের জন্য বিশেষভাবে বানানো তার H20 এআই চিপের উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে বেইজিং আগেই প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে ওই চিপ কেনা থেকে বিরত থাকতে বলেছিল। এর পরপরই চীনা প্রতিষ্ঠান ডিপসিক তাদের ফ্ল্যাগশিপ V3 মডেলের আপগ্রেড উন্মোচন করেছে, যেখানে নতুন প্রজন্মের দেশীয় চিপের জন্য সুযোগ রাখা হয়েছে। এটি নিছক কাকতালীয় নয়; বরং এটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে চীন এখন নিজের হার্ডওয়্যার দিয়ে নিজস্ব এআই চালানোর লড়াইয়ে নেমেছে।

এখনও পর্যন্ত এনভিডিয়া বিশ্ববাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। জেনারেটিভ এআই মডেল ট্রেনিংয়ের জন্য যে উচ্চক্ষমতার চিপ দরকার, তা মূলত তাদের হাতেই। কিন্তু প্রযুক্তির বিবর্তন নতুন এক বাস্তবতা তৈরি করছে—প্রি-ট্রেইন্ড মডেল থেকে উত্তর তৈরি করা বা ইনফারেন্সের জন্য যে চিপ লাগে, সেটি অনেক কম জটিল ও সাশ্রয়ী। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লাটনিক যে H20 চিপকে তাচ্ছিল্যের সুরে বলেছেন “আমাদের সেরা তিনটির মধ্যেও নেই,” সেই চিপ চীনা বাজারে বিক্রি হচ্ছিল এবং এই ধরনের কাজে যথেষ্ট উপযোগী। তাই অনুমান করা কঠিন নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপ্লিকেশন-স্পেসিফিক ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট বা ASIC ডিজাইন করা চীনা কোম্পানিগুলো এনভিডিয়ার সঙ্গে ব্যবধান দ্রুত কমিয়ে আনতে পারবে।

তবে চ্যালেঞ্জ কম নয়। চীন বহু বছর ধরে “জাতীয় চ্যাম্পিয়ন” তৈরির লক্ষ্যে সরকারি তহবিল ঢেলেছে। কিন্তু এর ফল সব সময় আশানুরূপ হয়নি। ২০২১ সালে সিংহুয়া ইউনিগ্রুপের দেউলিয়া হওয়া এবং পরবর্তী সময়ে “বিগ ফান্ড” নামে পরিচিত চায়না ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট ইন্ডাস্ট্রি ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের দুর্নীতি তদন্ত সেই ব্যর্থতার জ্বলন্ত উদাহরণ। অতিরিক্ত সরকারি সহায়তা প্রায়ই অপচয়, ঋণ আর জটিল দায়বদ্ধতার ফাঁদ তৈরি করে।

এই বাস্তবতার মাঝেই ক্যামব্রিকন টেকনোলজিসের উত্থান এক আলোকরেখা। ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই এআই চিপ ডিজাইনার মাত্র চার বছরের মাথায় সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের STAR বোর্ডে তালিকাভুক্ত হয়—একটি পাইলট প্রোগ্রাম, যা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং চালু করেছিলেন প্রযুক্তি স্টার্টআপগুলোকে দ্রুত শেয়ারবাজারে আনার জন্য। ইনফারেন্স চিপের বাজারে চীনের সম্ভাবনা বিনিয়োগকারীরা এতটাই গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন যে, ক্যামব্রিকন এখন প্রায় ৪০০ কোটি ইউয়ান (প্রায় ৫৬ কোটি মার্কিন ডলার) তোলার পরিকল্পনা করেছে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য। বিক্রি বাড়লেও এই তরুণ কোম্পানি এখনও লোকসান গুনছে—কিন্তু বাজারে আস্থা তাদের এগিয়ে রাখছে।

এখানেই শিক্ষা রয়েছে। ইউনিগ্রুপের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার জটিল কাঠামো শেষ পর্যন্ত কেবল বিভ্রান্তি ও দেউলিয়ার পথ তৈরি করেছে। অথচ শেয়ারবাজারের স্বচ্ছতা ও বিনিয়োগকারীদের প্রাকৃতিক যাচাই প্রক্রিয়া অনেক বেশি কার্যকর। সরকার এখানে মূলত নীতি নির্ধারক, কিন্তু প্রকৃত ঝুঁকি ও সুযোগের বিচার করছে বাজার নিজেই।

চীনের সাম্প্রতিক নীতিতেও সেই পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্যাভেকাল ড্রাগোনমিক্সের টিলি ঝ্যাং-এর ভাষায়, সরকার এখন “প্রারম্ভিক, ক্ষুদ্র, কঠিন” বিনিয়োগ নীতিতে ঝুঁকছে—ছোট কোম্পানির মূল প্রযুক্তিতে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল উৎসাহিত করছে। ক্যামব্রিকনের প্রতিষ্ঠাতা চেন তিয়ানশি এখনো কোম্পানির ২৯ শতাংশ শেয়ারের মালিক, আর চীনা অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেসের একটি সহযোগী সংস্থার হাতে রয়েছে ১৬ শতাংশ। ব্যক্তিগত মালিকানা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান—দুয়েরই এই সমন্বয় চীনের নতুন দিকনির্দেশনার প্রতিচ্ছবি।

একই সঙ্গে কম সমৃদ্ধ অঞ্চলের স্থানীয় সরকারগুলোকে কঠিন প্রযুক্তিতে অতিরিক্ত বিনিয়োগ না করার জন্য প্রেসিডেন্ট শির স্পষ্ট সতর্কবার্তা প্রমাণ করছে, বেইজিং এবার কেবল অর্থ ঢালার বদলে বিচক্ষণ পথ বেছে নিচ্ছে।

এই পথ দীর্ঘ ও কঠিন হলেও দিকনির্দেশনা স্পষ্ট। যদি চীন সত্যিই এনভিডিয়ার বিকল্প গড়তে চায়, তবে তরুণ স্টার্টআপগুলোকে যত দ্রুত সম্ভব শেয়ারবাজারে যেতে উৎসাহিত করাই হবে মূল চাবিকাঠি। কারণ বিনিয়োগকারীরা যখন নিজেদের “চীনা এনভিডিয়া” খুঁজতে নামবেন, তখন তারাই সরকারের হয়ে প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই করবেন। আর সেখান থেকেই জন্ম নেবে প্রকৃত জাতীয় চ্যাম্পিয়ন—যা চীনের প্রযুক্তি স্বনির্ভরতার স্বপ্নকে বাস্তবের আরও কাছে নিয়ে যাবে।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
সম্পাদকীয়

গবেষকের ক্যারিয়ার: বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে এক নতুন বাস্তবতা

ড. মশিউর রহমান বাংলাদেশের তরুণ গবেষকরা যখন উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যান,...

সম্পাদকীয়

বিদেশে গবেষণার সাহসী যাত্রা: নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষা

HFSP-এর মতো আন্তর্জাতিক ফেলোশিপের মাধ্যমে বাংলাদেশী তরুণ গবেষকরা কীভাবে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে...

সম্পাদকীয়

গবেষকের কূটনীতি: বিজ্ঞানের ভাষায় বিশ্বকে বোঝা

বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার মাধ্যমে গবেষকরা কীভাবে কূটনীতিক হিসেবে কাজ করতে পারেন তা আবিষ্কার...

সম্পাদকীয়

বিজ্ঞানীদের জন্য আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক করা কেন প্রয়োজন?

বিজ্ঞানীদের জন্য আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক কেন অপরিহার্য তা আবিষ্কার করুন। তরুণ বাংলাদেশী...

সম্পাদকীয়

আমাদের শিক্ষকেরা কেন নীরব?

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বাংলায় জনসাধারণের জন্য লেখার ক্ষেত্রে কেন নীরব? এই প্রবন্ধে...

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org