ড্রোনে ধারণকৃত এক সমন্বিত ছবিতে জেবেল মিসমার শিলাচিত্রে ১৯টি পূর্ণাঙ্গ উট ও ৩টি অশ্বের অবয়ব ধরা পড়েছে। প্রাচীন চিত্রগুলো সাদা আর অপেক্ষাকৃত পরবর্তী চিত্রগুলো নীল রঙে চিহ্নিত। মাপ বোঝাতে বাম পাশে একটি মানুষের অবয়বও যুক্ত করা হয়েছে। — সাহাউত রক আর্ট অ্যান্ড আর্কিওলজি প্রজেক্ট
ড্রোনে ধারণকৃত এক সমন্বিত ছবিতে জেবেল মিসমার শিলাচিত্রে ১৯টি পূর্ণাঙ্গ উট ও ৩টি অশ্বের অবয়ব ধরা পড়েছে। প্রাচীন চিত্রগুলো সাদা আর অপেক্ষাকৃত পরবর্তী চিত্রগুলো নীল রঙে চিহ্নিত। মাপ বোঝাতে বাম পাশে একটি মানুষের অবয়বও যুক্ত করা হয়েছে। — সাহাউত রক আর্ট অ্যান্ড আর্কিওলজি প্রজেক্ট
আরব উপদ্বীপ আমাদের মুসলিম সভ্যতার হৃদয়ভূমি। এখানেই ইসলামের জন্ম, এখানেই নবী-রাসূলদের পদচিহ্ন, এখানেই আল্লাহর ওহি নাজিল হয়েছে। কিন্তু এই ভূমির ইতিহাস কেবল ১৪ শতকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এটি হাজার বছরের পুরোনো এক সভ্যতার ধারক-বাহক। সম্প্রতি নেফুদ মরুভূমির কাছে প্রত্নতাত্ত্বিকরা যে শিল্প আবিষ্কার করেছেন, তা আমাদের সেই দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অমূল্য দলিল।
চারটি দূরবর্তী পাথুরে প্রাচীরে পাওয়া গেছে প্রায় ১৩০টি খোদাই করা প্রাণীর প্রতিকৃতি। এর মধ্যে নব্বইয়েরও বেশি হলো উট—যাদের আকার মানুষের সমান বড়, দেড় থেকে আড়াই মিটার দীর্ঘ। প্রতিটি উটকে খোদাই করা হয়েছে আশ্চর্য নিপুণতায়, যেন শিল্পীরা জীবন্ত প্রাণীর শরীর থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন। উটের লোমশ দেহ, মিলন ঋতুর ভঙ্গি—সবই ফুটে উঠেছে এই শৈল্পিক রেখার ভেতর।
কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“তারা কি উটের দিকে লক্ষ্য করে না, কিভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে?”
(সূরা গাশিয়াহ (৮৮), আয়াত ১৭)।
মরুভূমির এই প্রতীকী প্রাণী ছিল মানুষের ধৈর্য, সহনশীলতা ও টিকে থাকার শিক্ষাগুরু। তাই অবাক হবার কিছু নেই যে, হাজার বছর আগেও মরুভূমির মানুষ উটকেই বেছে নিয়েছিল তাদের শিল্পের কেন্দ্রে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলছেন, এই খোদাইগুলো ছিল কেবল শিল্প নয়; বরং পানির উৎসের দিশা দেখানোর মানচিত্রও। খোদাইয়ের পথ ধরে গেলে দেখা যায়—পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে আছে একটি হ্রদ। অর্থাৎ, পাথরের বুকই ছিল তখনকার মানুষের জীবনরক্ষার মানচিত্র।
কুরআনে ‘আদ’ ও ‘সামূদ’ জাতির কথা এসেছে—যারা পাহাড় কেটে ঘর বানাতো, উন্নত সভ্যতা গড়ে তুলেছিল, কিন্তু সীমালঙ্ঘনের কারণে ধ্বংস হয়েছিল। (সূরা হুদ, আয়াত ৫০-৬৮)। আজকের এই প্রত্নআবিষ্কার সেই কাহিনির বৈজ্ঞানিক প্রতিধ্বনি। বারো হাজার বছরের পুরোনো উটের শিল্পকর্ম প্রমাণ করছে—ইসলামের আগমন ঘটার বহু আগে থেকেই আরব ভূমি ছিল সংস্কৃতি, জ্ঞান ও সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, শিল্পীরা শত ফুট উঁচু খাড়া প্রাচীরে দাঁড়ানোর মতো সামান্য জায়গা নিয়ে খোদাই করেছেন এই বিশাল প্রতিকৃতি। তাদের হাতে ছিল কেবল পাথরের হাতিয়ার। অসংখ্য আঘাত, সীমাহীন ধৈর্য আর কল্পনাশক্তি দিয়ে তারা গড়েছেন এমন এক শিল্প, যা আজও অটুট। গবেষণা বলছে, এই খোদাইয়ের বয়স অন্তত ১২,০০০ বছর—অর্থাৎ ইউরোপের বিখ্যাত গুহাচিত্রের সমসাময়িক।
এই আবিষ্কার শুধু প্রত্নতত্ত্ব নয়, মুসলিম ঐতিহ্যের সাথেও গভীরভাবে সংযুক্ত। আল্লাহ কুরআনে নির্দেশ দিয়েছেন: “তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো, অতীতের জাতিগুলোর পরিণতি দেখো।” (সূরা রুম, আয়াত ৪২)। মরুভূমির উটের এই খোদাই আমাদের সেই শিক্ষাই মনে করিয়ে দেয়—সভ্যতা গড়ে ওঠে, বিকশিত হয়, আবার বিলীনও হয়ে যায়; কিন্তু তাদের চিহ্ন হয়ে থাকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয়।
আজকের তরুণ মুসলিম প্রজন্মের জন্য এই আবিষ্কার অনুপ্রেরণার এক নতুন উৎস। কারণ এটি প্রমাণ করে, ইসলামের ভূমি কেবল আধ্যাত্মিক কেন্দ্র নয়; বরং হাজার বছরের জ্ঞান, শিল্প ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করে আসছে। ইসলাম সেই দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ধারাকে নতুন আলোয় আলোকিত করেছে—তাওহিদের ছায়ায় রূপ দিয়েছে সত্যিকারের মানবসভ্যতায়।
মরুভূমির পাথরে খোদাই করা উটগুলো যেন আজও আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে—বলছে, “দেখো, তোমাদের অতীত কত সমৃদ্ধ ছিল।” আমাদের দায়িত্ব সেই ঐতিহ্যকে জানতে, বুঝতে এবং নতুন প্রজন্মকে জানাতে। কারণ যে জাতি নিজের ইতিহাসকে ভুলে যায়, সে জাতি কখনো ভবিষ্যতের পথ দেখাতে পারে না।
Leave a comment