সম্পাদকীয়

আমাদের শিক্ষকেরা কেন নীরব?

Share
Share

ড. মশিউর রহমান

আমাদের দেশে একটি অদ্ভুত বৈপরীত্য আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাঁদের গবেষণা নিয়ে আন্তর্জাতিক জার্নালে অনবরত লিখছেন, বিদেশি পাঠকের জন্য রাত জেগে পাণ্ডুলিপি তৈরি করছেন, কিন্তু নিজেদের দেশের মানুষের জন্য, বাংলাভাষী সমাজের জন্য তাঁদের কলম প্রায় স্তব্ধ। এই নীরবতাকে আর কতোদিন মেনে নেব আমরা?

পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকান। সেখানকার শিক্ষকরা শুধু গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ থাকেন না, তাঁরা সমাজের সাথে প্রতিনিয়ত কথোপকথনে জড়িত। সংবাদপত্রে লিখছেন, ম্যাগাজিনে লিখছেন, টেলিভিশনে বিশ্লেষণ করছেন। সাধারণ মানুষ জানছে, বিজ্ঞানের অগ্রগতি তাঁদের জীবনে কী অর্থ বহন করছে। আর আমাদের দেশে? আমাদের শিক্ষকরা রাজনীতি নিয়ে কলম ধরতে ভালোবাসেন, কিন্তু তাঁদের বিশেষজ্ঞতার বিষয় নিয়ে জনসাধারণকে আলোকিত করতে খুব কমই লিখেন।

এই ফাঁক পূরণ করতে গিয়ে অনেক সময় সাংবাদিকরা বিজ্ঞান সংবাদ কভার করেন। কিন্তু সমস্যাটা এখানেই। সাংবাদিকেরা বিজ্ঞান বোঝেন না, গবেষণার খুঁটিনাটি ধরতে পারেন না। ফলে একটি ক্ষুদ্র গবেষণাকেও তাঁরা “অসাধারণ আবিষ্কার” বানিয়ে ফেলে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেন। এতে পাঠক বিভ্রান্ত হন, গবেষকও অযথা প্রচারের শিকার হন। অথচ যদি শিক্ষকরা নিজেরাই লিখতেন, তবে কোনো বিকৃতির সুযোগ থাকত না।

তাহলে প্রশ্ন একটাই—শিক্ষকেরা কেন লেখেন না? অনেকের অজুহাত, বাংলায় লেখার অনভ্যাস। তাঁরা ইংরেজিতে অভ্যস্ত, বাংলায় লেখার ভয় কাটাতে পারেন না। কিন্তু এ ভয় কি যুক্তিযুক্ত? যাঁরা প্রতিদিন জ্ঞান বিতরণের কাজ করেন, যাঁদের কণ্ঠে তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়, তাঁরা কি বাংলায় সাধারণ পাঠকের সাথে কথা বলতে পারবেন না? নাকি তাঁরা সচেতনভাবেই নীরব থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?

বিশ্ববিদ্যালয় কেবল পাঠদান বা গবেষণাপত্র প্রকাশের কেন্দ্র নয়। এটি একটি সমাজের নৈতিক ও জ্ঞানভিত্তিক দিকনির্দেশক প্রতিষ্ঠান। শিক্ষকরা যদি তাঁদের জ্ঞান জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত না করেন, তবে বিশ্ববিদ্যালয় তার আসল ভূমিকা হারায়। পশ্চিমা বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমাজের আস্থা অর্জন করেছে মূলত এজন্য যে তাঁদের শিক্ষকরা জনগণের সাথে কথোপকথনে অংশ নিয়েছেন। আমাদের শিক্ষকরা যদি এই দায়িত্ব এড়িয়ে যান, তবে তাঁরা কেবল নিজেদের গণ্ডিতেই আবদ্ধ থাকবেন।

ডিজিটাল যুগে লেখালেখির মাধ্যমের অভাব নেই। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, ব্লগ, সংবাদপত্র, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও হতে পারে বিজ্ঞানের ভাষ্য ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্র। প্রশ্ন হলো, আমাদের শিক্ষকরা কি সত্যিই চান সমাজ তাঁদের কাছ থেকে শিখুক? নাকি তাঁরা কেবল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য লিখেই সন্তুষ্ট?

আমি স্পষ্ট করে বলি—এটি কেবল সাংবাদিক বা প্ল্যাটফর্মের দায়িত্ব নয় যে তাঁরা গবেষকের ভাষা জনগণের কাছে পৌঁছে দেবেন। এটি শিক্ষকের নিজস্ব নৈতিক দায়িত্ব। আপনারা যদি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে জ্ঞানই উন্নতির মূল হাতিয়ার, তবে আপনারা কেন নীরব? কেন আপনারা নিজের বিশেষজ্ঞতাকে সমাজের সাথে ভাগ করছেন না?

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার উপর। কিন্তু সেই সমাজ গড়তে হলে শিক্ষকদের কলমকে সামনে আসতেই হবে। আপনাদের নীরবতা আমাদের অগ্রগতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা। তাই আজ প্রশ্ন রাখছি—শিক্ষকেরা, আপনারা কি নীরব থেকে যাবেন, নাকি অবশেষে কলম ধরবেন?

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
সম্পাদকীয়

বিদেশে গবেষণার সাহসী যাত্রা: নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষা

HFSP-এর মতো আন্তর্জাতিক ফেলোশিপের মাধ্যমে বাংলাদেশী তরুণ গবেষকরা কীভাবে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে...

সম্পাদকীয়

গবেষকের কূটনীতি: বিজ্ঞানের ভাষায় বিশ্বকে বোঝা

বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার মাধ্যমে গবেষকরা কীভাবে কূটনীতিক হিসেবে কাজ করতে পারেন তা আবিষ্কার...

সম্পাদকীয়

বিজ্ঞানীদের জন্য আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক করা কেন প্রয়োজন?

বিজ্ঞানীদের জন্য আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক কেন অপরিহার্য তা আবিষ্কার করুন। তরুণ বাংলাদেশী...

সম্পাদকীয়

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ন্ত্রণের চাবি কার হাতে?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এজেন্টরা কীভাবে আমাদের বিশ্বকে নতুন করে রূপ দিচ্ছে তা আবিষ্কার...

সম্পাদকীয়

গবেষক থেকে উদ্যোক্তা—বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে সমাজে পৌঁছে দেওয়ার পথ

বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনকে বাস্তব-বিশ্বের সমাধানে রূপান্তরিত করে গবেষকরা কীভাবে উদ্যোক্তা হতে পারেন তা...

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org