ড. মশিউর রহমান
মানবসভ্যতা সব সময়ই প্রযুক্তির দ্বারা বিস্মিত হয়েছে। কখনো তা এসেছে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের গর্জনে, কখনো বিদ্যুতের আলোয়, আবার কখনো ইন্টারনেটের অসীম জগতে। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই–এর উত্থান যেন সেই বিস্ময়ের সীমাকেও ভেঙে দিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে “এআই এজেন্ট” নামের নতুন এক প্রযুক্তি দ্রুত বিশ্বজুড়ে আলোচনায় এসেছে। এগুলো আর শুধু মানুষের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া চ্যাটবট নয়, বরং বাস্তব পৃথিবীতে মানুষের অনুপস্থিতিতেই সিদ্ধান্ত নিতে ও কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম সত্তায় রূপ নিচ্ছে। এখন প্রশ্ন উঠছে—আমরা কি প্রস্তুত এই নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে তুলে দিতে?
২০১০ সালের ৬ মে বিকেল ২টা ৩২ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে যা ঘটেছিল, তা এই আশঙ্কার প্রমাণ দেয়। মাত্র কুড়ি মিনিটে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। ইতিহাসে এটিই ছিল সবচেয়ে দ্রুত বাজারধস, যাকে বলা হয় “ফ্ল্যাশ ক্র্যাশ।” পরে তদন্তে দেখা গেল, এই ধসের প্রধান ত্বরক ছিল উচ্চ-গতির ট্রেডিং অ্যালগরিদম, যারা মুহূর্তের মধ্যে শেয়ার কেনা–বেচা করে। দাম সামান্য নামতেই অ্যালগরিদমগুলো দ্রুত বিক্রি শুরু করে, ফলে দাম আরও পড়ে যায়। মানুষ কখনোই এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারত না, কিন্তু এই যন্ত্রীয় গতি বাজারকে ভয়াবহভাবে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এখানেই লুকিয়ে আছে এআই এজেন্টের দ্বন্দ্ব—তাদের উপযোগিতা আসে মানুষের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই কাজ করার ক্ষমতা থেকে, অথচ সেই নিয়ন্ত্রণহীনতাই বড় বিপদের উৎস।
প্রকৃতপক্ষে, এআই এজেন্ট নতুন কিছু নয়। আমাদের ঘরের থার্মোস্ট্যাট, অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার কিংবা রোবোটিক ভ্যাকুয়াম ক্লিনার—সবই একেকটি এজেন্ট। এগুলো নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে। কিন্তু নতুনত্ব এসেছে বড় ভাষাভিত্তিক মডেল বা এলএলএম–এর ব্যবহারে। এখন এজেন্ট কেবল তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ বা মেঝে পরিষ্কার করছে না, বরং ইন্টারনেট ব্রাউজ করছে, রেস্টুরেন্টে টেবিল বুক করছে, ওয়েবসাইট বানাচ্ছে, এমনকি সফটওয়্যার কোডও পরিবর্তন করছে। ওপেনএআইয়ের অপারেটর, অ্যানথ্রপিকের কোড কিংবা চীনা স্টার্টআপের ম্যানাস দেখাচ্ছে, এজেন্ট কত দ্রুত আমাদের বাস্তব জগতে প্রবেশ করছে।
এই প্রবণতায় ব্যবসায়ী জগত যেন নতুন স্বপ্ন দেখছে। ওপেনএআইয়ের প্রধান স্যাম অল্টম্যান ঘোষণা দিয়েছেন, এ বছরই এজেন্টরা “কর্মক্ষেত্রে যোগ দেবে।” সেলসফোর্সের প্রধান মার্ক বেনিওফ তৈরি করেছেন এজেন্টফোর্স, যেখানে কোম্পানিগুলো নিজেদের প্রয়োজনে এজেন্ট কাস্টমাইজ করতে পারবে। এমনকি মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরও সামরিক প্রয়োগের জন্য এজেন্ট তৈরির চুক্তি করেছে। একদিকে সম্ভাবনার দ্বার খুলছে, অন্যদিকে ঝুঁকির ছায়াও ঘন হচ্ছে।
বিখ্যাত কম্পিউটার বিজ্ঞানী ইয়োশুয়া বেঞ্জিও সতর্ক করে বলেছেন, এলএলএম–ভিত্তিক এজেন্টদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার ঝুঁকি ভয়াবহ। চ্যাটবট হিসেবে তারা কেবল টেক্সটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, কিন্তু এজেন্ট হিসেবে বাস্তব জগতে পদক্ষেপ নিতে পারে। ভাবুন, কোনো এজেন্ট যদি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রবেশাধিকার পেয়ে যায়—সে হয়তো বাজেট ম্যানেজ করবে, আবার সব সঞ্চয় উড়িয়ে দিতে বা হ্যাকারকে তথ্য ফাঁস করতেও পারে। ভয়াবহ দিক হলো, এই সিস্টেমগুলো কখনো কখনো নিজেকে নকল করে ছড়িয়ে পড়তে বা বন্ধ হওয়ার বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম হতে পারে। বেঞ্জিওর ভাষায়, আমরা যেন মানবজাতিকে “রাশিয়ান রুলেট” খেলায় বসিয়ে দিচ্ছি।
কিন্তু ঝুঁকির তালিকা এখানেই শেষ নয়। মানুষের নির্দেশেই এই এজেন্টগুলো ভয়াবহ অস্ত্রে পরিণত হতে পারে। কোনো ক্ষতিকর ব্যক্তি যদি এজেন্টকে সাইবার আক্রমণের নির্দেশ দেয়, তবে সে মুহূর্তে হাজারো আক্রমণ চালাতে সক্ষম হবে। ইতিমধ্যেই গবেষকেরা দেখিয়েছেন, দলবদ্ধ এজেন্ট “জিরো-ডে” দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে অজানা সিস্টেম হ্যাক করতে পারে। এমনকি ভুয়া ওয়েবসাইটে ফাঁদ পাতলে দেখা গেছে, এজেন্টরাই সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। অর্থাৎ, সাইবারস্পেসে এক নতুন ঝড় আসছে।
অন্যদিকে, স্বস্তির দিকও আছে। কর্মক্ষেত্রে ইমেইলের জবাব দেওয়া, মিটিং শিডিউল করা, ভ্রমণ বুকিং—সবকিছুই সহজ হয়ে যাবে এজেন্টের মাধ্যমে। তবে এই স্বস্তি কি নিরাপত্তাহীনতার বিনিময়ে আসবে? ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জিওফ্রে ফাউলার যেমন অভিজ্ঞতা করেছেন—তিনি এজেন্টকে সস্তা ডিম খুঁজতে বলেছিলেন, আর হঠাৎই দরজায় এসে হাজির হলো ৩১ ডলারের ইনস্টাকার্ট অর্ডার, যার অনুমতি তিনি কখনো দেননি। ছোট একটি ভুল হয়তো হাস্যকর মনে হয়, কিন্তু এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের বড় বিপদের ইঙ্গিত।
আরও বড় উদ্বেগ কর্মসংস্থান নিয়ে। সফটওয়্যার ডেভেলপার থেকে শুরু করে কল সেন্টারের কর্মী—অনেক পেশাই ঝুঁকির মুখে। কিছু অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, আগামী চার বছরের মধ্যে এজেন্টরা এক মাসের সমপরিমাণ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং নিজেরাই করে ফেলতে পারবে। এর মানে কি আমরা এক নতুন বেকারত্ব সংকটে যাচ্ছি? নাকি মানুষ–এজেন্ট একসঙ্গে কাজ করার নতুন ভারসাম্য খুঁজে পাবে? কেবল অর্থনৈতিক ঝুঁকিই নয়, রাজনৈতিক ঝুঁকিও সামনে আসছে। যদি সরকার বা প্রভাবশালী কোনো সংস্থা মানুষ বাদ দিয়ে অন্ধ আনুগত্যশীল এজেন্ট ব্যবহার করে, তবে গণতান্ত্রিক ভারসাম্য ভেঙে পড়তে পারে। মানুষ প্রশ্ন করে, বিতর্ক করে, নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে। কিন্তু এজেন্ট কেবল নির্দেশ পালন করবে। এর ফলে ক্ষমতাসীনদের হাতে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই অবস্থায় সমাধান কোথায়? একদিকে প্রযুক্তি নিরাপত্তা বাড়ানো, সাইবার সুরক্ষা জোরদার করা, প্রি-ডিপ্লয়মেন্ট টেস্টিং করা জরুরি। অর্থাৎ সত্যিকারের প্রয়োগের আগে ভালোমতন পর্যবেক্ষণ করে অন্যদিকে নীতিনির্ধারণে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, বেকার ভাতা বা মৌলিক আয়ের মতো নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সমাজকে প্রস্তুত রাখতে হলে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা কি এজেন্টদের কেবল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবো, নাকি তাদের অন্ধ আনুগত্যে নিজেদের ঝুঁকির মুখে ফেলবো?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এজেন্ট আমাদের জীবনে বাস্তব পরিবর্তন আনবেই, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। হয়তো আমরা আরও উৎপাদনশীল হবো, পরিবারকে সময় দেওয়ার সুযোগ পাবো, কিংবা জটিল সমস্যার সমাধানও এজেন্টের হাতে তুলে দিতে পারবো। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ হারানোর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। প্রযুক্তি সব সময়ই সুযোগের সাথে দায় চাপায়। এজেন্টের ক্ষেত্রেও সেই নিয়মই প্রযোজ্য। তাই এখনই প্রশ্ন করতে হবে—আমরা কি বুদ্ধিমত্তাকে আমাদের হাতিয়ার বানাবো, নাকি তাকে নিয়ন্ত্রণহীন শক্তিতে পরিণত করবো?
Leave a comment