সম্পাদকীয়

বিদ্যুৎ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জ্বালানি সংকট

Share
Share

ড. মশিউর রহমান

ক্ষমতা কেবল রাজনৈতিক বা সামরিক এর সাথে সম্পর্কিত ব্যাপার নয়—এটি অর্থনীতি, উৎপাদনশীলতা, প্রযুক্তি, এমনকি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক গতি নির্ধারণ করে দেয়। আর এই ক্ষমতার ভিত্তি হচ্ছে শক্তি, অর্থাৎ জ্বালানি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির উপর নিয়ন্ত্রণ থাকলে এক দেশ বা প্রতিষ্ঠান শুধু নিজস্ব প্রয়োজনই মেটাতে পারে না, বরং তার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং উন্নয়নের ধারা নির্ধারণ করাও সম্ভব হয়। বাংলাদেশ এই বাস্তবতার বাইরে নয়।

গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকদূর এগিয়েছে। পোশাক শিল্প, কৃষি, রেমিট্যান্স এবং সাম্প্রতিক সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি— সব মিলিয়ে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রশংসনীয়। এই প্রবৃদ্ধির পিছনে অনেক কারণ থাকলেও আমার মতে, এই প্রবৃদ্ধির একটি কেন্দ্রবিন্দু হলো বিদ্যুৎ। কৃষকের সেচ যন্ত্র থেকে শুরু করে ঢাকার ডেটা সেন্টার, ছোট উদ্যোক্তার মেশিন থেকে শুরু করে মেট্রোরেলের চলমান গতি— সবকিছুই নির্ভর করছে বিদ্যুতের সরবরাহ ও নিরবচ্ছিন্নতার ওপর। অথচ এই বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি আলোচনাই আমরা দেখি না।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI প্রযুক্তি বাংলাদেশে এখনো প্রাথমিক স্তরে থাকলেও এর সম্ভাবনা বিশাল। সরকারি দপ্তর, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা ও ব্যবসার নানা খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি প্রয়োগ শুরু হয়েছে। স্টার্টআপ, ব্যাংক এবং ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করছে গ্রাহক সেবা ও ডেটা বিশ্লেষণে। কিন্তু এই প্রযুক্তির একটি মৌলিক শর্ত হলো বিদ্যুৎ। বাংলাদেশে যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ডেটা সেন্টার বা মেশিন লার্নিং মডেল চালুর কথা বলা হচ্ছে, তখন প্রশ্ন ওঠে—এই বিপুল বিদ্যুৎ চাহিদা আমরা কীভাবে পূরণ করবো?

বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার বড় অংশ এখনো জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। কয়লা, তেল ও গ্যাসের মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ একদিকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ তৈরি করে। তেলের দাম বাড়লেই সরকারের ভর্তুকি বেড়ে যায়, বাজেটের ভারসাম্য নড়ে ওঠে। অথচ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি ব্যবহার ক্রমশ বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। এ অবস্থায়, যদি পরিচ্ছন্ন শক্তির দিকে শক্তভাবে এগোনো না যায়, তাহলে একসময় বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

এই বাস্তবতা মাথায় রেখে ভাবতে হবে—আমরা কোন পথে যাচ্ছি? আজ যখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দিনের পর দিন লোডশেডিং চলছে, তখন কল্পনা করা কঠিন নয়, ভবিষ্যতে যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা বা শিল্প খাত আরও বিস্তৃত হয়, তাহলে বিদ্যুৎ ঘাটতি সেই সম্ভাবনাকে কীভাবে ব্যাহত করতে পারে। কল্পনা করুন—কোনো হাসপাতাল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত রোগ নির্ণয়ের যন্ত্র ব্যবহার করছে, কিন্তু হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় তা বন্ধ হয়ে গেল। কিংবা কোনো স্কুলে শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল এজেন্টের মাধ্যমে পাঠ নিচ্ছে, হঠাৎ নেটওয়ার্ক ডাউন, কারণ ব্যাকএন্ড ডেটা সেন্টারে বিদ্যুৎ নেই। এই ছোট ছোট দৃশ্য একসময় বড় প্রেক্ষাপট তৈরি করবে।

পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উৎপাদনের দিকে বাংলাদেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে ঠিকই—ঘরোয়া পর্যায়ে সৌর প্যানেলের ব্যবহার বেড়েছে, সৌরচালিত আইসোলেশন হাসপাতাল তৈরি হয়েছে, কয়েকটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু আছে। তবে তা এখনো প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এলএনজি বা তরল প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানিতে নির্ভর করছে, যার ভবিষ্যৎ মূল্য স্থিতিশীল নয়। উপরন্তু, রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর নির্ভরতা দেশের অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর হতে পারে। তেলের দাম বেড়ে গেলে যেমন সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ে, তেমনি বৈদ্যুতিক সেবার ব্যয়ও তখন জনগণের কাঁধে এসে পড়ে।

আমাদের এখন প্রয়োজন একটি সমন্বিত জ্বালানি নীতি—যেখানে জীবাশ্ম জ্বালানি এবং নবায়নযোগ্য শক্তি একসঙ্গে বিবেচনায় থাকবে। শুধু সৌর বা বায়ু নয়, পারমাণবিক শক্তি, জলবিদ্যুৎ, বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদন এবং গ্রিডভিত্তিক ব্যাটারি সংরক্ষণ ব্যবস্থাও এর অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গবেষণা সংস্থা এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে, আগামী ২০ বছরের জন্য একটি বাস্তবভিত্তিক শক্তি রূপরেখা তৈরি করা উচিত। যাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির প্রসার এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে।

শক্তি ছাড়া কোনো কল্পনা টিকবে না। প্রযুক্তি জ্ঞান বা আইডিয়া যত বড়ই হোক না কেন, যদি তার বাস্তবায়নের জ্বালানি না থাকে, তাহলে তা কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আমাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিকল্পনার সঙ্গে জ্বালানি নীতির সমন্বয় ঘটাতে হবে। কারণ, আগামী দিনে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হবে বিদ্যুৎ, এবং সে বিদ্যুৎ নির্ধারণ করবে আমরা ডিজিটাল উন্নয়নের পথে এগোতে পারবো কি না।

বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল ও সম্ভাবনাময় দেশ যদি এখন থেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিকে গ্রহণ করে, এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি কাঠামো গড়ে তোলে, তাহলে সেটিই হতে পারে আমাদের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির ভিত্তি। আমরা যদি শুধু প্রতিক্রিয়া জানাই, ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা না করি, তাহলে হয়তো সামনে এসে দাঁড়াবে এমন এক বাস্তবতা, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থাকবে, কিন্তু তার জন্য পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ থাকবে না। তখন প্রযুক্তি আর সমৃদ্ধি দুটোই থাকবে কেবল পোস্টারে—বাস্তবে নয়।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org