চিকিৎসা বিদ্যাস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

বয়স ধীর বা দ্রুত বাড়ে কেন? রাজনীতি ও বৈষম্যের অদৃশ্য প্রভাব

Share
Share

নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ

আমরা সবাই বয়স বাড়ার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি—একটি দেশের মানুষ গড়ে কত দ্রুত বার্ধক্যে পৌঁছায়? অথবা এই গতি দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর কতটা নির্ভর করে? সম্প্রতি Nature Medicine-এ প্রকাশিত এক বিস্তৃত গবেষণা জানাচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের বয়স বাড়ার গতি এক নয়, এবং এর পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতা, গণতান্ত্রিক অবক্ষয় এবং সামাজিক বৈষম্য বড় ভূমিকা রাখে।

এই বৈশ্বিক গবেষণা চারটি মহাদেশের ৪০টি দেশের প্রায় ১.৬ লাখ মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করে। গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন ল্যাটিন আমেরিকান ব্রেইন হেলথ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. আগুস্তিন ইবানেজ এবং তাঁর আন্তর্জাতিক সহকর্মীরা।

বয়স শুধু সময়ের হিসাব নয়

বয়স সাধারণত সময় দিয়ে মাপা হয়—কত বছর বেঁচে আছি তা দিয়েই বিচার করি আমরা। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, শারীরিক ও মানসিকভাবে কেউ কারও চেয়ে “বয়সে বড়” বা “ছোট” হতে পারেন, যদিও উভয়ের জন্ম তারিখ একই। এই পার্থক্য বোঝাতে বিজ্ঞানীরা এখন ব্যবহার করছেন “বায়োবিহেভিয়ারাল এজ গ্যাপ” নামক একটি ধারণা।

এটি বোঝায় প্রকৃত বয়সের সঙ্গে শরীর-মন অনুযায়ী অনুমিত বয়সের ব্যবধান। যেমন, যদি কারো প্রকৃত বয়স হয় ৫০ বছর, কিন্তু বিভিন্ন স্বাস্থ্য ও আচরণগত উপাত্ত অনুযায়ী তার বয়স অনুমান করা হয় ৬০ বছর—তাহলে তার বায়োবিহেভিয়ারাল গ্যাপ ১০ বছর।

গবেষকরা একটি মেশিন লার্নিং মডেলের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রত্যেকের অনুমানিক বয়স নির্ধারণ করেছেন, যা প্রকৃত বয়সের সঙ্গে তুলনা করে বয়স বৃদ্ধির গতি পরিমাপ করেছেন।

দ্রুত বয়স বৃদ্ধির কারণ কী?

গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, শ্রবণ সমস্যা ইত্যাদি স্বাস্থ্যগত কারণ দ্রুত বয়স বাড়ার জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অতিরিক্ত ওজন, অ্যালকোহল গ্রহণ, ঘুমের সমস্যা, ডায়াবেটিস ও দৃষ্টিশক্তির দুর্বলতা।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, শুধু শারীরিক কারণ নয়—রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশও বয়স বৃদ্ধিতে বড় প্রভাব ফেলছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা, রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাধীনতায় বাধা, ভোটাধিকার সংকোচন ইত্যাদি বিষয়গুলো মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে, যার শারীরিক প্রতিক্রিয়ায় বয়স দ্রুত বাড়ে।

গবেষণার প্রধান লেখক ইবানেজ বলেন, “আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি যেখানে রাজনৈতিক মেরুকরণ, অনিশ্চয়তা ও হতাশা বাড়ছে। এটি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে, অথচ আমরা সেদিকে তেমন নজর দিচ্ছি না।”

শিক্ষা ও সচেতনতা: প্রতিরোধের প্রধান অস্ত্র

সবচেয়ে আশার কথা হলো—বয়স ধীর গতিতে বাড়ানোর কিছু উপায় রয়েছে। এই গবেষণায় সবচেয়ে বড় সুরক্ষাকারী হিসেবে উঠে এসেছে শিক্ষা। যে মানুষ বেশি শিক্ষিত, তার বয়স তুলনামূলক ধীরে বাড়ে।

শুধু শিক্ষা নয়—যারা দৈনন্দিন কাজ নিজে করতে পারেন, যাদের মস্তিষ্ক সুস্থভাবে কাজ করে, যাদের স্মৃতি ভালো, যাঁরা শারীরিকভাবে সক্রিয় এবং ভালো হাঁটতে পারেন—তাঁদের বয়স বৃদ্ধির হার কম।

এই গবেষণার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, কিছু মানুষের ক্ষেত্রে দেখা গেছে তারা জীববৈজ্ঞানিকভাবে বাস্তব বয়সের চেয়ে অনেক কম বয়সী। এই ব্যতিক্রমী ব্যক্তিদের জীবনধারা বিশ্লেষণ করলে হয়তো ভবিষ্যতে এমন কিছু হস্তক্ষেপের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে, যা সবার জন্য উপকারী হতে পারে।

কোন অঞ্চলে বয়স দ্রুত বাড়ে?

এই গবেষণায় দেখা গেছে, আফ্রিকার মিশর ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বয়স বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি, যেখানে ইউরোপীয় দেশগুলোতে সবচেয়ে ধীর গতিতে বয়স বাড়ে। এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো রয়েছে মাঝামাঝি জায়গায়।

রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভোটাধিকার সংকোচন, আয় বৈষম্য, বায়ু দূষণ, লিঙ্গ বৈষম্য এবং নিম্ন আয় এসবই বয়স দ্রুত বৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ২১,৬০০ জনের চার বছর সময়কালীন তথ্য পাওয়া গেছে। এই অংশের বিশ্লেষণে দেখা যায়—যাদের বয়সের ব্যবধান (বায়োবিহেভিয়ারাল এজ গ্যাপ) বেশি, তাদের কগনিটিভ স্কিল বা চিন্তাশক্তি এবং দৈনন্দিন কাজের দক্ষতা দ্রুত হ্রাস পায়।

কেন এই ধরনের গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ?

ব্রাজিলের সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের জেরিয়াট্রিক বিশেষজ্ঞ ক্লাউডিয়া সুয়েমোটো, যিনি গবেষণায় সরাসরি জড়িত ছিলেন না, বলেন—“এই গবেষণা আমাদের দেখায়, কীভাবে রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের বয়স বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে। এটি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশ্বিক চিত্র তুলে ধরে।”

তবে গবেষণার কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন, ধূমপানের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান অনেক দেশে আলাদা পদ্ধতিতে পরিমাপ করা হয়, তাই সেটি বাদ দিতে হয়েছে। আবার মাত্র চার বছরের অনুসন্ধানকাল বয়স বৃদ্ধির মত ধীরপ্রক্রিয়ার জন্য যথেষ্ট নয় বলেও মন্তব্য করেছেন সুয়েমোটো।

বার্তা বাংলাদেশের জন্য

এই গবেষণার ফলাফল বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ মধ্যবয়স বা প্রবীণদের দিকে এগোচ্ছে। শিক্ষার হার, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তা, পরিবেশ দূষণ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা—সব মিলিয়ে বয়স বৃদ্ধির গতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা একটি জাতীয় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।

সামাজিক বৈষম্য, বায়ু দূষণ, মানসিক চাপ এবং অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের মতো দেশে মানুষের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা ঝুঁকির মুখে পড়ছে। এই গবেষণা আমাদের আরও সচেতন হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে—বয়স ধীর করতে হলে শুধু চিকিৎসা নয়, উন্নত শিক্ষা, স্থিতিশীল গণতন্ত্র ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশের প্রয়োজন।

শেষ কথা

বয়স ধরা যায় না, সময়কে আটকে রাখা যায় না—তবে বয়স কীভাবে বাড়বে, কত দ্রুত বাড়বে, সেটা অনেকটাই নির্ভর করে আমাদের সমাজ, রাজনীতি ও ব্যক্তিগত জীবনধারার ওপর। নতুন গবেষণাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে—স্বাস্থ্য মানে শুধু শরীর নয়, বরং সমাজ, রাজনীতি ও পরিবেশও আমাদের দীর্ঘজীবনের অংশ। তাই দীর্ঘজীবী ও সুস্থ থাকতে হলে প্রয়োজন এক বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি—যেখানে ব্যক্তিগত চেষ্টার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় নীতিমালাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।


সূত্র: এই প্রতিবেদনটি Scientific American এবং Nature Medicine-এ প্রকাশিত গবেষণার ভিত্তিতে প্রস্তুত।
মূল প্রবন্ধ: Aging Rates Vary by Country. Politics Might Be Why – Scientific American

📧 আপনার মতামত ও প্রশ্ন পাঠান: [email protected]
🌐 আরও পড়ুন: www.biggani.org

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org