পদার্থবিদ্যাবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বলের রহস্য উদঘাটনের নতুন যুগ

Share
Share

নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ

মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বল হিসেবে পরিচিত “স্ট্রং ফোর্স” বা প্রবল নিউক্লীয় বলের রহস্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীদের মধ্যে ছিল গভীর কৌতূহল। এই বলটি এতটাই শক্তিশালী যে এটি কোয়ার্কগুলোকে একত্রিত করে প্রোটন ও নিউট্রনের মতো মৌলিক কণা তৈরি করে এবং এই নিউক্লিয়নগুলোকে একত্রিত করে পরমাণুর নিউক্লিয়াস গঠন করে। গ্রাভিটি, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক এবং দুর্বল নিউক্লীয় বলের মতো মহাবিশ্বের চার মৌলিক বলের মধ্যে প্রবল নিউক্লীয় বলের শক্তি সবচেয়ে বেশি—গ্রাভিটি থেকে প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন গুণ বেশি। কিন্তু এর কার্যপ্রণালি ছিল সবচেয়ে রহস্যজনক ও দুর্বোধ্য।

প্রবল নিউক্লীয় বলের শক্তি বা “কাপলিং কনস্ট্যান্ট” (αs) অত্যন্ত জটিলভাবে গণনা করতে হয়, কারণ এর বাহক কণা গ্লুওন নিজের সঙ্গে নিজেই মিথস্ক্রিয়া করতে পারে। অন্যদিকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বলের বাহক কণা ফোটন নিজের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে না, তাই এটি তুলনামূলক সহজে পরিমাপ করা যায়। কিন্তু প্রবল বলের ক্ষেত্রে এই স্ব-মিথস্ক্রিয়া জটিলতা সৃষ্টি করে।

এতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা উচ্চশক্তির ক্ষেত্রে সীমিত আকারে αs পরিমাপ করতে পারলেও দৈনন্দিন জীবনের প্রাসঙ্গিক নিম্নশক্তির এলাকায়—যেখানে এই বল সত্যিকার অর্থেই প্রবল—সেখানে এর নির্ভুল মান নির্ধারণ করা যায়নি। এই এলাকাকে বিজ্ঞানীরা “টেরা ড্যামনাটা” (Terra Damnata) বা অভিশপ্ত ভূমি হিসেবে উল্লেখ করতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় অবশেষে এই রহস্যের দ্বার খুলতে শুরু করেছে।

বিগত দুই দশকের গবেষণায় এই রহস্যভূমির রহস্য উন্মোচিত হতে শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টমাস জেফারসন ন্যাশনাল অ্যাক্সিলারেটর ফ্যাসিলিটির গবেষক আলেক্সান্ড্রে ডিউর ২০০৫ সালে প্রথমবারের মতো নিম্নশক্তির স্কেলে প্রবল বলের শক্তি পরিমাপ করতে সক্ষম হন। তিনি দেখেন, দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে αs এর মান ক্রমাগত বাড়তে থাকে না বরং একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে পৌঁছে স্থির হয়ে যায়। এ তথ্য প্রচলিত তত্ত্বের বিপরীত ছিল, যেখানে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন যে দূরত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে αs এর মান অসীম হয়ে যাবে।

ডিউরের এই অপ্রত্যাশিত আবিষ্কার দ্রুত অন্যান্য বিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। স্ট্যানলি ব্রডস্কি ও ক্রেইগ রবার্টসের মতো শীর্ষ পদার্থবিদরা এই ফলাফলের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা খুঁজতে শুরু করেন। ব্রডস্কি তার সহযোগীদের নিয়ে “লাইট-ফ্রন্ট হলোগ্রাফি” নামক একটি নতুন গণনা পদ্ধতির সাহায্যে দেখান যে, দূরত্ব বৃদ্ধি পেলেও αs একটি নির্দিষ্ট মানেই থেমে যায়। তাদের এই পদ্ধতি অতিরিক্ত কোনো গাণিতিক প্যারামিটার বা “ফাজ ফ্যাক্টর” ছাড়াই নিখুঁতভাবে ডিউরের পরীক্ষাগত তথ্যের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।

পাশাপাশি ক্রেইগ রবার্টস “কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিক্স” (QCD)-এর মৌলিক সমীকরণ ব্যবহার করে স্বাধীনভাবে এই ফলাফল নিশ্চিত করেন। রবার্টস এবং তার সহযোগীরা তাদের গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, প্রবল নিউক্লীয় বলের কাপলিং কনস্ট্যান্টের (αs) দূরত্ব-নির্ভর পরিবর্তন প্রকৃতপক্ষে একটি সীমিত ও নির্দিষ্ট মানে গিয়ে স্থিতিশীল হয়ে যায়। এই সমাধান একটি দীর্ঘদিনের বিরোধ নিরসন করে এবং QCD-এর সমীকরণ থেকে এই মানের সার্বজনীনতার প্রমাণও দেয়।

এই নতুন আবিষ্কারের ফলে মহাবিশ্বের মৌলিক বলের তত্ত্বে বিপ্লব ঘটে যেতে পারে। কারণ, এই বলের স্থির মান বিজ্ঞানীদের অনেক জটিল বিষয় যেমন পরমাণু এবং তার মধ্যেকার প্রোটন-নিউট্রনের ভর সম্পর্কে নতুন করে বুঝতে সাহায্য করে। গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন যে, দৃশ্যমান মহাবিশ্বের প্রায় ৯৯ শতাংশ ভরের উৎস এই প্রবল নিউক্লীয় বল। অর্থাৎ, আমরা প্রতিদিন যে ভর অনুভব করি তার বেশিরভাগই আসে QCD-এর মাধ্যমে কোয়ার্কের চারপাশে গ্লুওনের শক্তিশালী বলের দ্বারা তৈরি শক্তি থেকে।

এই গবেষণার আরেকটি বড় অবদান হলো, প্রবল নিউক্লীয় বলের এই নতুন বোঝাপড়ার ফলে একীকৃত মহাজাগতিক তত্ত্ব, উচ্চতর মাত্রা বা বহুমাত্রিক মহাবিশ্ব সম্পর্কে নতুন চিন্তার দরজা খুলে দিতে পারে। QCD হলো প্রথম পূর্ণাঙ্গ কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব যা কেবল সীমিত মানের ভবিষ্যদ্বাণী দেয়, যেখানে অন্যান্য তত্ত্বে অসীম মানের সমস্যা দেখা দেয়। এর ফলে ভবিষ্যতের গবেষণায় পদার্থবিদ্যার অনেক রহস্যের সমাধান সম্ভব হতে পারে।

অর্থাৎ, বিজ্ঞানীরা প্রবল নিউক্লীয় বলের রহস্যময় জগত “টেরা ড্যামনাটা”-কে এখন আর অভিশপ্ত নয়, বরং বিজ্ঞান গবেষণার এক নতুন সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করছেন।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org