পরিবেশ ও পৃথিবীসাধারণ বিজ্ঞান

বাংলাদেশের শহরে পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনের গবেষণা কি বলে?

Share
Share

এক সময় বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের সকাল মানেই ছিল পাখির কলকাকলি, শিশিরভেজা পাতার সুবাস এবং সূর্যের প্রথম আলোয় নতুন দিনের আহ্বান। কিন্তু দ্রুত নগরায়ণ ও পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে সেই চেনা দৃশ্য আজ বিরল। শহরের বহু সাধারণ প্রজাতির পাখি এখন বিলুপ্তির পথে।

পাখি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক নয়—তারা নগরীর বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পাখি পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ, বীজ বিস্তার এবং খাদ্য শৃঙ্খলার ভারসাম্য রক্ষায় অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। তবুও, নগরায়ণ, দূষণ, এবং খাদ্যের ঘাটতি তাদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান:

  • IUCN Bangladesh Red List (2015) অনুসারে, বাংলাদেশে মোট ১,৬১৯টি পাখি প্রজাতির মূল্যায়ন করা হয়, যার মধ্যে অন্তত ২৪% (প্রায় ৩৯০ প্রজাতি) “Threatened” ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত।
  • BirdLife International (State of the World’s Birds 2022) অনুসারে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪৯% পাখি প্রজাতির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, মাত্র ৬% প্রজাতির সংখ্যা বাড়ছে, এবং প্রতি ৮টি পাখির মধ্যে ১টি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।
  • স্থানীয় পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও সিলেটের বড় শহরগুলোতে গৃহস্থালির চড়ুই, দোয়েল ও শালিকের সংখ্যা গত এক দশকে দ্রুত কমেছে।

এর কারনগুলো কি কি?

বাসস্থান ধ্বংস (Habitat Loss):

কারণ: দ্রুত নগরায়ণ, বহুতল ভবন, সড়ক ও শিল্পাঞ্চল নির্মাণে গাছপালা, ঝোপঝাড়, জলাশয় ও খোলা মাঠ ধ্বংস হচ্ছে। এগুলোই ছিল পাখিদের প্রজনন, বিশ্রাম এবং খাদ্য সংগ্রহের মূল স্থান।

প্রভাব:

  • বাসা বানানোর স্থান হারিয়ে পাখিরা স্থানান্তরে বাধ্য হচ্ছে।
  • স্থায়ীভাবে শহরে বসবাসকারী প্রজাতিগুলোর স্থানীয় বিলুপ্তি ঘটছে।

উদাহরণ: ঢাকায় House Sparrow বা গৃহস্থালির চড়ুইয়ের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে গেছে।

গবেষণা সূত্র: BirdLife International বলছে, নগর এলাকায় বাসস্থান ধ্বংসই পাখির সংখ্যা হ্রাসের সবচেয়ে বড় কারণ।

শব্দ দূষণ (Noise Pollution):

কারণ: যানবাহনের হর্ন, মেট্রোর শব্দ, নির্মাণকাজের ড্রিল, এবং কারখানার যন্ত্রপাতি থেকে নিরবচ্ছিন্ন শব্দ প্রাকৃতিক “soundscape” নষ্ট করছে।

প্রভাব:

  • পাখির ডাক ও গান পরিবর্তিত হয়, যা সঙ্গী আকর্ষণ ও এলাকা চিহ্নিতকরণে ব্যর্থতা আনে।
  • শিকারির সতর্ক সংকেত দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, ফলে প্রজনন সাফল্য কমে।

গবেষণা উদাহরণ: ইউরোপে Great Tit প্রজাতি শহরের উচ্চ শব্দমাত্রায় গান উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সিতে গায়, যা প্রজননে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

কীটনাশকের ব্যবহার (Pesticide Use):

কারণ: শহুরে বাগান, ছাদবাগান ও কৃষিজমিতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার পোকামাকড়ের সংখ্যা হ্রাস করছে।

প্রভাব:

  • পোকা-খেকো পাখিদের খাদ্য সরবরাহ কমে যাচ্ছে।
  • কীটনাশকের রাসায়নিক শরীরে জমে ডিমের খোলস পাতলা হয়ে যায় (DDT যুগের মতো ঘটনা)।

গবেষণা উদাহরণ: যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণায় Neonicotinoid কীটনাশক পাখিদের ওজন কমিয়ে দেয় এবং প্রজনন কমায়।

খাদ্যের ঘাটতি (Food Scarcity):

কারণ: ফলগাছ, ফুলগাছ ও তৃণভূমি হারিয়ে যাওয়ায় বীজ, ফল ও পোকামাকড়ের প্রাচুর্য কমে গেছে।

প্রভাব:

  • খাদ্য সংকটে অনেক পাখি শহর ত্যাগ করছে।
  • অপুষ্টি ও প্রজনন ব্যর্থতার হার বাড়ছে।

উদাহরণ: নগর এলাকায় দোয়েল, শালিক, চড়ুইয়ের খাদ্য উৎস আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে।

সমাধানঃ

  1. বাসস্থান সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার: শহরে সবুজ করিডোর তৈরি, স্থানীয় প্রজাতির গাছ লাগানো, পুরনো গাছ সংরক্ষণ।
  2. শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ: নীরব অঞ্চল তৈরি, হর্ন সীমাবদ্ধকরণ, নির্মাণে শব্দ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র।
  3. রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ: জৈব কৃষি, প্রাকৃতিক পোকা নিয়ন্ত্রণ, কীটনাশকের আইনগত সীমাবদ্ধতা।
  4. খাদ্য উৎস বৃদ্ধি: পার্ক ও ছাদবাগানে ফুল, ফল, বীজ উৎপাদনকারী গাছ লাগানো; বার্ড ফিডার স্থাপন।
  5. আইনগত সুরক্ষা ও গবেষণা: প্রজনন মৌসুমে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা, পাখি মনিটরিং প্রোগ্রাম, শিকার নিষিদ্ধ।
  6. জনসচেতনতা: স্কুলে বার্ড ক্লাব, সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারণা, বার্ষিক পাখি গণনা।

শেষ কথাঃ

পাখি সংরক্ষণ শুধু একটি প্রজাতি রক্ষার বিষয় নয়—এটি আমাদের পরিবেশ, কৃষি এবং মানসিক স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা। বাংলাদেশের শহরে পাখি সংরক্ষণে নগর পরিকল্পনা, আইন প্রয়োগ, ও জনসম্পৃক্ততা একসাথে কাজ করতে হবে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে আগামী এক-দুই দশকে বহু পরিচিত পাখি শুধুই ইতিহাস হয়ে যাবে।


মোঃ ফাহাদ হুসাইন
শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
কৃষিপরিবেশ ও পৃথিবী

পানিই জীবন, আবার পানিই মরণ!

বাংলাদেশের মিরসরাইয়ের কৃষকরা কীভাবে পানির লবণাক্ততা এবং বন্যার সাথে লড়াই করছেন এবং...

গল্পে গল্পে বিজ্ঞানসাধারণ বিজ্ঞান

রঙের বিজ্ঞান: চোখের খেলায় বিজ্ঞানের বিস্ময়

আমরা রঙ কীভাবে দেখি তার পিছনের বিজ্ঞান আবিষ্কার করুন — আলোক তরঙ্গ...

গল্পে গল্পে বিজ্ঞানসাধারণ বিজ্ঞান

কেন আমরা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হই?—বিজ্ঞানের আলোকে ভালোবাসা ও আকর্ষণের গল্প

কেন আমরা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হই? মানুষের আকর্ষণের পিছনে প্রেম, মস্তিষ্কের...

ইতিহাসের এই দিনেসাধারণ বিজ্ঞান

বয়সের হদিস: প্রাচীন জিনিসের বয়স কীভাবে নির্ধারণ করেন বিজ্ঞানীরা?

সহজ বাংলা ভাষায় কার্বন-১৪, পটাসিয়াম-আর্গন এবং অন্যান্য ডেটিং পদ্ধতি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা...

মহাকাশসাধারণ বিজ্ঞান

সূর্য নিভে গেলে জীবন কী টিকে থাকবে?

সূর্যের মৃত্যু হলে জীবনের কী হবে? পৃথিবীর ভবিষ্যৎ, প্লুটোতে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.