বর্তমান সময়ে অনলাইনে যে ধরণের প্রতারণা সবচেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে, তার মধ্যে অর্গানিক ফুড প্রোডাক্টের নামে ব্যবসা অন্যতম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা অনলাইন মার্কেটপ্লেস খুললেই চোখে পড়ে চটকদার বিজ্ঞাপন—“আমাদের পণ্য সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে তৈরি”, “প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর” ইত্যাদি নানা দাবিতে ভরপুর। অথচ বাস্তবতা হলো, এই দাবির আড়ালে অনেক ক্ষেত্রেই বিক্রি হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে উৎপাদিত পণ্য, যার সঙ্গে প্রকৃত অর্গানিক উৎপাদনের কোনো সম্পর্কই নেই। দাম রাখা হচ্ছে দ্বিগুণ, যেন নামেই অর্গানিক হলেই তার মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে যায়।
বাংলাদেশে এখনো ‘Bangladesh Organic Certification Authority’ খুব সীমিত আকারে কার্যক্রম চালাচ্ছে। অথচ প্রকৃত অর্গানিক পণ্য বিক্রি করতে হলে এই সংস্থার অনুমোদন থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু অনলাইনে যারা অর্গানিক পণ্য বিক্রি করছে, তাদের ৯৯ শতাংশেরই কোনো সার্টিফিকেশন নেই। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, ক্রেতাদের আস্থার সুযোগ নিয়ে কীভাবে একটি বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে।
আসলে অর্গানিক সার্টিফিকেশন পাওয়ার জন্য যে শর্তগুলো মেনে চলতে হয়, তা অত্যন্ত কঠোর। উৎপাদন পর্যায়ে কোনো ধরনের কৃত্রিম রাসায়নিক সার, কীটনাশক, হার্বিসাইড বা জেনেটিকালি মডিফায়েড অর্গানিজম (GMO) ব্যবহার একেবারেই নিষিদ্ধ। জমি অন্তত তিন বছর ধরে কেবল জৈব পদ্ধতিতে ব্যবহার করতে হয়, যাতে মাটির গুণগত মান সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক থাকে। প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় শুধুমাত্র অনুমোদিত প্রাকৃতিক উপাদান ও সংযোজক ব্যবহার করা যাবে; কোনো কৃত্রিম রঙ, ফ্লেভার বা সংরক্ষণকারী যোগ করা যাবে না। এমনকি প্যাকেটের গায়ে ‘Certified Organic’ লেখা বা সংশ্লিষ্ট সার্টিফিকেশন লোগো থাকতে হবে, আর উপাদান তালিকায় কত শতাংশ অর্গানিক উপাদান আছে, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।
এখন দেখা যাচ্ছে, বাজারে যেসব পণ্য ‘অর্গানিক’ নামে বিক্রি হচ্ছে—সরিষার তেল, ঘি, মেহেদি, তালমিছরি বা হানিনাটস—তাদের কারো কাছেই কোনো সার্টিফিকেট নেই। প্রোডাক্টগুলো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পদ্ধতিতেই তৈরি, তবুও অর্গানিক নামের মোড়কে সেগুলো উচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, অর্গানিক ঘি উৎপাদন করতে হলে অবশ্যই এমন গরুর দুধ ব্যবহার করতে হবে যেগুলো কোনো প্রোবায়োটিক হরমোন, অ্যান্টিবায়োটিক বা কেমিক্যালযুক্ত খাবার খায়নি। এরপর সেই দুধকে প্রথাগতভাবে ফারমেন্ট করে মাখন তুলতে হয়। কিন্তু বাস্তবে কি এমনটাই হচ্ছে? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নয়।
একইভাবে, অর্গানিক সরিষার তেল পেতে হলে সরিষা চাষে কোনো ধরনের হার্বিসাইড, পেস্টিসাইড বা রাসায়নিক সার ব্যবহার করা যাবে না এবং কাঠের ঘানিতে (কোল্ড প্রেস) ভেঙে কাপড়ে ছেকে তেল বের করতে হবে। কিন্তু বাজারের তথাকথিত ‘অর্গানিক’ তেলের উৎপাদন প্রক্রিয়া কি আসলেই এমন? বেশিরভাগ সময়ই না। অথচ এই তেলের দাম রাখা হচ্ছে ৩৫০ টাকা লিটার, যেখানে সাধারণ বাজারে মিল-ভাঙানো সরিষার তেল পাওয়া যাচ্ছে ২২০ টাকায়। ক্রেতার মনে স্বাস্থ্য সচেতনতার আবেগ জাগিয়ে মুনাফা করার এ যেন এক নীরব প্রতারণা।
অতএব, সচেতন ভোক্তা হিসেবে আমাদের বোঝা জরুরি যে ‘অর্গানিক’ শব্দটি কেবল একটি লেবেল নয়, বরং এটি একটি কঠোর মানদণ্ড অনুসারে প্রমাণিত উৎপাদন পদ্ধতির প্রতিফলন। কাগজে-কলমে বা বিজ্ঞাপনের ভাষায় নয়, প্রমাণিত সার্টিফিকেশনের মাধ্যমে সত্যিকারের অর্গানিক পণ্য চেনা সম্ভব। নইলে আমরা কেবল নামের মোহে পড়ে অর্থ ব্যয় করব, অথচ প্রকৃত স্বাস্থ্যসুবিধা পাব না—এবং প্রতারক ব্যবসায়ীদের সেই সুযোগ করে দেব নিজের হাতে।
তাহসিন আহমেদ সুপ্তি
শিক্ষার্থী (উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ),জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
অণুজীববিজ্ঞান, এগ্রোনমি ও হর্টিকালচার বিষয়ে আগ্রহী।
Leave a comment