সৌদি আরব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অবকাঠামোয় এক বড় পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশটির এআই কোম্পানি ‘হিউমেইন’ (HUMAIN)–এর মাধ্যমে ওপেনএআই–এর দুটি উন্নত মডেল এখন সম্পূর্ণভাবে সৌদি মাটিতে চালানো হচ্ছে। এর ফলে ইনপুট থেকে আউটপুট পর্যন্ত সবকিছু দেশের অভ্যন্তরেই সম্পন্ন হচ্ছে, কোনো তথ্য দেশের বাইরে যাচ্ছে না। মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গ্রকের (Groq) উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রসেসর এবং দাম্মামে স্থাপিত ডেটা সেন্টারের মাধ্যমে এই অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। সৌদি সরকারের ৯০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সম্পদের সার্বভৌম বিনিয়োগ তহবিল (PIF)–এর অর্থায়নে এই প্রকল্প দেশটিকে প্রযুক্তি স্বায়ত্তশাসনের পথে এগিয়ে দিচ্ছে।
প্রযুক্তি জগতে এই পদক্ষেপের গুরুত্ব বোঝার জন্য আমাদের ভাবতে হবে, সাধারণত আমরা চ্যাটজিপিটি বা অনুরূপ এআই টুল ব্যবহার করলে কী ঘটে। ব্যবহারকারীর পাঠানো প্রশ্ন প্রথমে বিদেশি সার্ভারে যায়, সেখানে মডেল সেটি প্রক্রিয়া করে এবং উত্তর পাঠায়। এতে সময় লাগে, আর তথ্যের নিরাপত্তা থাকে অন্য দেশের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু সৌদি আরবের ক্ষেত্রে পুরো প্রক্রিয়াটিই এখন স্থানীয়ভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। এর মানে, গতি বেড়েছে, ডেটা সুরক্ষা শক্তিশালী হয়েছে এবং তথ্যের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এসেছে দেশের হাতে।
হিউমেইনের এই প্রকল্পের পেছনে যুক্ত হয়েছে গ্রক প্রযুক্তি—যা অত্যন্ত দ্রুতগতির প্রসেসর তৈরি করে, বিশেষত বড় আকারের এআই মডেল চালানোর জন্য। সৌদি আরব ১.৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগে এই অবকাঠামো দাঁড় করিয়েছে। দাম্মামের ডেটা সেন্টার থেকে দেশটির শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, স্বাস্থ্য ও শিল্পক্ষেত্র সরাসরি উপকৃত হবে।
এখানে যে মূল ধারণাটি সামনে আসে তা হলো “সার্বভৌম এআই” বা Sovereign AI—যেখানে একটি দেশ নিজের এআই অবকাঠামো এবং তথ্য প্রক্রিয়াকরণ সম্পূর্ণ নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখে। এটি শুধু আত্মনির্ভরতার প্রতীক নয়; এটি জাতীয় নিরাপত্তা, শিক্ষা, গবেষণা এবং শিল্পের জন্য কৌশলগত সম্পদ। এই মডেলে কোনো দেশ বিদেশি সার্ভার বা বহিরাগত নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে নিজের মতো করে গড়ে তুলতে পারে।
বিশ্বব্যাপী যখন এআই নীতি, ডেটা সুরক্ষা এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে বিতর্ক তীব্র হচ্ছে, তখন সৌদি আরবের এই উদ্যোগ এক ধরনের পাল্টা জবাব। এটি দেখিয়ে দিচ্ছে, বড় বিনিয়োগ ও পরিকল্পনার মাধ্যমে কীভাবে একটি দেশ ভবিষ্যতের প্রযুক্তি প্রতিযোগিতায় নিজেদের জন্য জায়গা তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য এখান থেকে নেওয়ার মতো শিক্ষা রয়েছে। আমাদের ডিজিটাল অবকাঠামো দ্রুত বিকশিত হলেও, এআই প্রযুক্তি পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটিং এবং ডেটা প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা এখনো সীমিত। অধিকাংশ এআই সেবা বিদেশি সার্ভারের ওপর নির্ভরশীল, যা গতি ও নিরাপত্তা উভয় ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, দুর্যোগ পূর্বাভাস বা শিক্ষা—এসব ক্ষেত্রে যদি স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষিত এআই মডেল ব্যবহার করা যায়, তাহলে শুধু সেবার মান বাড়বে না, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ও নীতি–নির্ধারণে স্বাধীনতাও আসবে।
বাংলাদেশ চাইলে ধাপে ধাপে একটি সার্বভৌম এআই রোডম্যাপ অনুসরণ করতে পারে। প্রথম ধাপে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগে হাই-পারফরম্যান্স কম্পিউটিং সুবিধা স্থাপন করা যেতে পারে। দ্বিতীয় ধাপে সেই অবকাঠামো বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও স্টার্টআপদের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে, যাতে তারা স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী মডেল তৈরি করতে পারে। তৃতীয় ধাপে খাতভিত্তিক ডেটাসেট তৈরি করা হবে—যেমন স্বাস্থ্য, কৃষি বা পরিবহন—যাতে ভবিষ্যতের মডেলগুলো বিশ্বমানের হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় প্রেক্ষাপটে কার্যকর হয়।
নীতিগত সহায়তাও সমান জরুরি। ডেটা সুরক্ষা আইনকে হালনাগাদ করা, দেশীয় উদ্ভাবনকে কর ছাড় ও অনুদানের মাধ্যমে উৎসাহিত করা, এবং বিদেশি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিতে ডেটা মালিকানা ও প্রক্রিয়াকরণের শর্ত স্বচ্ছ রাখা—এসব পদক্ষেপ প্রযুক্তি স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তি তৈরি করবে।
আজকের বিশ্বে ডেটা হলো নতুন তেল, আর এআই হলো সেই তেল শোধনাগার। সৌদি আরব এই সত্যটি খুব ভালোভাবে বুঝেছে বলেই এমন বিনিয়োগ করছে। তাদের উদ্দেশ্য শুধু প্রযুক্তি ব্যবহার নয়, বরং প্রযুক্তি প্রবাহের কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া। শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, জ্বালানি ও শিল্পক্ষেত্রে তারা যে এআই–নির্ভর পরিকল্পনা করছে, তা সরাসরি এই অবকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তি অবকাঠামো কেবল অর্থনীতির অংশ নয়, বরং ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশ। যার কাছে ডেটা ও এআই প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা আছে, তার হাতেই ভবিষ্যতের নীতি ও বাজারের চাবিকাঠি। সৌদি আরবের দাম্মামের ডেটা সেন্টার তাই শুধু সার্ভারের সমষ্টি নয়, এটি এক ধরনের ঘোষণা—তারা প্রযুক্তিগত স্বায়ত্তশাসনের পথে পা বাড়িয়েছে।
এই প্রবণতা শুধু সৌদি আরবেই সীমাবদ্ধ নয়; সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইউরোপের বেশ কিছু দেশও একই পথে হাঁটছে। এতে একটি বৈশ্বিক ধারা তৈরি হচ্ছে, যেখানে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে দেশভিত্তিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে বাধ্য করা হচ্ছে, যাতে ডেটা দেশের বাইরে না যায়।
বাংলাদেশের জন্যও এখন প্রশ্ন হলো—আমরা কি কেবল প্রযুক্তি ব্যবহারকারী হয়েই থাকব, নাকি প্রযুক্তির মালিকানা ও অবকাঠামো নিয়ন্ত্রণের পথেও এগোব? এআই–এর মতো কৌশলগত প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা মানে শুধু বর্তমান নয়, বরং আগামী প্রজন্মের জন্য এক নিরাপদ, উদ্ভাবন–সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের সার্বভৌম এআই–এর ৫ বছরের রোডম্যাপ
প্রথম বছর: ভিত্তি স্থাপন ও সচেতনতা তৈরি। সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি খাত ও উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি জাতীয় এআই টাস্কফোর্স গঠন করে নীতি, বাজেট ও কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ। সরকারি–বেসরকারি অংশীদারিত্বে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ডেটা সেন্টারের কাজ শুরু।
দ্বিতীয় বছর: অবকাঠামো চালু ও গবেষণা সহায়তা। ডেটা সেন্টার চালু করে বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও স্টার্টআপদের জন্য উন্মুক্ত রাখা। স্থানীয় ভাষা ও প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক ডেটাসেট সংগ্রহ ও উন্নয়ন।
তৃতীয় বছর: খাতভিত্তিক এআই অ্যাপ্লিকেশন। স্বাস্থ্য, কৃষি, দুর্যোগ পূর্বাভাস, পরিবহন ও শিক্ষা খাতে স্থানীয় ডেটা দিয়ে প্রশিক্ষিত এআই সমাধান চালু।
চতুর্থ বছর: আইন, নীতি ও নিরাপত্তা শক্তিশালীকরণ। ডেটা সুরক্ষা আইন হালনাগাদ এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিতে ডেটা সার্বভৌমত্বের শর্ত অন্তর্ভুক্ত করা। এআই–ভিত্তিক সাইবার নিরাপত্তা অবকাঠামো গড়ে তোলা।
পঞ্চম বছর: আঞ্চলিক প্রযুক্তি নেতৃত্ব ও রপ্তানি। সার্বভৌম এআই–এর অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রযুক্তি কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং স্থানীয়ভাবে তৈরি এআই সমাধান বিদেশে রপ্তানি।
Leave a comment