নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
১৮ জুলাই ২০২৫
বিশ্বজগৎের সবচেয়ে জটিল এবং মৌলিক প্রশ্নগুলোর একটি হলো: আমরা যারা পদার্থ দিয়ে গঠিত, তারা কেন অস্তিত্বশীল, আর কেন এই মহাবিশ্ব শূন্যতায় ভরে নেই? বিজ্ঞানীদের মতে, মহাবিশ্বের জন্মের সময় সমান পরিমাণ পদার্থ (matter) ও বিপরীতধর্মী অ্যান্টিম্যাটার (antimatter) সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু যখনই এই দুই একত্রে আসে, তারা একে অপরকে ধ্বংস করে দেয়। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, কীভাবে কিছু পরিমাণ পদার্থ টিকে গেল?
এই গভীর রহস্যের উত্তর খুঁজতেই বিজ্ঞানীরা নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছেন, আর এবারে CERN-এর লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (Large Hadron Collider বা LHC) হতে পাওয়া এক নতুন আবিষ্কার এই অনুসন্ধানে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
অ্যান্টিম্যাটারের অদ্ভুত আচরণ ধরা পড়ল ব্যারিয়নের মধ্যে
সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের LHCb (Large Hadron Collider beauty) পরীক্ষণস্থলে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো এক বিশেষ শ্রেণির কণার মধ্যে CP violation এর প্রমাণ পেয়েছেন। এ ধরনের বিরল ঘটনা পদার্থ ও অ্যান্টিম্যাটারের আচরণগত পার্থক্য বোঝাতে সাহায্য করে।
সাধারণভাবে, পদার্থ ও অ্যান্টিম্যাটার একে অপরের আয়ন প্রতিচ্ছবি—তাদের সব বৈশিষ্ট্য এক, শুধু বৈদ্যুতিক আধান ছাড়া। কিন্তু যখনই তারা কিছুটা ভিন্ন আচরণ করে, বিজ্ঞানীরা দারুণ উৎসাহিত হন। কারণ, এ ধরনের ভিন্নতা যদি যথেষ্ট পরিমাণে প্রমাণ করা যায়, তবে সেটি ব্যাখ্যা করতে পারে কেন পদার্থ বেঁচে থাকলো, অথচ অ্যান্টিম্যাটার ধ্বংস হয়ে গেল।
ব্যারিয়ন কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ব্যারিয়ন এমন এক শ্রেণির কণা, যা তিনটি কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত—যেমন প্রোটন ও নিউট্রন, যা আমাদের প্রতিটি পরমাণুর মূল উপাদান। LHCb-তে বিজ্ঞানীরা এমন ব্যারিয়নের মধ্যে গবেষণা চালিয়েছেন যেগুলো আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক এবং একটি ‘বিউটি কোয়ার্ক’ দিয়ে গঠিত।
এবারের পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই বিউটি কোয়ার্কযুক্ত ব্যারিয়ন পদার্থ তাদের অ্যান্টিম্যাটার সংস্করণের তুলনায় আলাদা হারে ভেঙে পড়ছে বা decaying হচ্ছে। এটি CP symmetry ভঙ্গের (violation of charge conjugation–parity symmetry) একটি সরাসরি প্রমাণ।
এই আবিষ্কার কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
পেকিং ইউনিভার্সিটির গবেষক শুয়েটিং ইয়াং, যিনি LHCb টিমের অংশ ছিলেন, বলেন, “ব্যারিয়নের মধ্যে এই প্রথমবার CP violation ধরা পড়া একটি বড় মাইলফলক। কারণ ব্যারিয়ন দিয়েই গঠিত আমাদের জগত, আর এই ভিন্নতার সূত্র ধরেই হয়তো আমরা বুঝে উঠতে পারব কেন পদার্থ টিকে আছে।”
প্রখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিদ এডওয়ার্ড উইটেন বলেন, “এটি একটি চমৎকার পরিমাপ। ব্যারিয়নের মতো কঠিন কণার মধ্যে এই ভিন্নতা খুঁজে বের করা দারুণ সাফল্য।”
কিভাবে পরীক্ষা চালানো হয়?
LHCb হলো প্রায় ৬৯ ফুট দীর্ঘ ও ৬০০০ টন ওজনের এক সুবিশাল যন্ত্র, যা প্রতিসেকেন্ডে প্রায় ২০ কোটি প্রোটন সংঘর্ষ ঘটায়। এই সংঘর্ষে তৈরি হওয়া প্রচণ্ড শক্তির ফলে নানা নতুন কণা জন্ম নেয়—সেগুলোরই মধ্যে কেউ কেউ ব্যারিয়ন।
এমন প্রতিটি সংঘর্ষের ফলাফল বিশ্লেষণ করতে LHCb ব্যবহার করে এক “চার-মাত্রিক ক্যামেরা”, যা প্রতিটি কণার অবস্থান, গতি ও সময়ের হিসাব রাখে। গবেষক ভিনসেনজো ভ্যাগনোনি জানান, “এই ডিটেক্টর আমাদের সব তথ্য দেয়, যা দিয়ে আমরা প্রতিটি কণার জন্ম, পরিবর্তন ও পতনের পূর্ণ ইতিহাস বুঝে নিতে পারি।”
তবে কি এই আবিষ্কারে সব রহস্য সমাধান হয়ে গেল?
না। বিজ্ঞানীদের মতে, এই নতুন ব্যারিয়নে পাওয়া CP violation এখনো স্ট্যান্ডার্ড মডেল (Standard Model) নামক বর্তমান পদার্থবিজ্ঞানের মূল তত্ত্বের মধ্যেই পড়ে। মানে, এটি কোনো বড় অনিয়ম নয়। তবে এই পরিমাণ ভিন্নতা মোটেই যথেষ্ট নয় পুরো মহাবিশ্বে পদার্থের আধিক্য বোঝাতে।
ডারহ্যাম ইউনিভার্সিটির তাত্ত্বিক পদার্থবিদ জেসিকা টার্নার বলেন, “এই ফলাফল অভূতপূর্ব নয়। এটি কেবল পূর্ববর্তী কোয়ার্ক-ভিত্তিক মডেলের সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ।”
তাহলে কিভাবে রহস্যের সমাধান হবে?
গবেষকরা মনে করেন, আমাদের দেখা জগতের মতো পদার্থ–অ্যান্টিম্যাটার ভিন্নতার জন্য হয়তো এমন কিছু কণা বা প্রক্রিয়া রয়েছে যা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। সম্ভবত মহাবিশ্বের প্রারম্ভিক কালে এসব কণাই এমন পার্থক্য সৃষ্টি করেছিল, যা পদার্থকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছে।
ভ্যাগনোনি বলেন, “আমরা স্ট্যান্ডার্ড মডেল থেকে সামান্য বিচ্যুতি খুঁজছি। যদি কোথাও ভিন্নতা পাই, তাহলে বুঝতে পারব বর্তমান মডেলে কোথায় ঘাটতি রয়েছে।”
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
এই আবিষ্কারের গুরুত্ব এই জায়গায় যে, এখন বিজ্ঞানীদের সামনে নতুন প্রশ্ন ও অনুসন্ধানের পথ খুলে গেছে। LHCb ভবিষ্যতে আরও প্রায় ৩০ গুণ বেশি ডেটা সংগ্রহ করবে, যেগুলো দিয়ে আরও দুর্লভ CP violation অনুসন্ধান করা যাবে। এর মাধ্যমে হয়তো একদিন আমরা উত্তর পেয়ে যাব সেই প্রশ্নের: “কেন কিছু আছে, আর কিছুই নেই কেন?”
উপসংহার
এই গবেষণা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, পদার্থবিজ্ঞান শুধু তত্ত্বের খেলা নয়—এটি আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনের এক নিরন্তর প্রচেষ্টা। লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের মতো গবেষণা প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের জানার সীমাকে আরও বিস্তৃত করছে। হয়তো একদিন আমরা সত্যিই জানতে পারব, কেন আমরা এই মহাবিশ্বে আছি—পদার্থে গঠিত, প্রাণে ভরপুর।
সূত্র:
- ক্লারা মোস্কোভিত্স, সায়েন্টিফিক আমেরিকান
- LHCb Collaboration, Nature, July 2025
📩 প্রশ্ন বা মতামত পাঠান: [email protected]
🌐 আরও বিজ্ঞান সংবাদ পড়ুন: biggani.org
Leave a comment