তিন স্তরের তরলগতির ব্যাখ্যা এক সূত্রে গাঁথলেন গবেষকরা, পূর্ণ হলো হিলবার্টের স্বপ্নের একটি অধ্যায়
একদা এক স্বপ্ন ছিল—একটি একক ভাষায় গোটা বিশ্বের জটিলতাকে ব্যাখ্যা করা। একটি সূত্র, যা পদার্থবিজ্ঞানের অণু-পরমাণু থেকে শুরু করে বিশাল মহাকাশ—সবকিছুকে যুক্তির সীমায় নিয়ে আসবে।
১৯০০ সালের প্যারিসে, ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ ম্যাথেমেটিশিয়ানস-এ দাঁড়িয়ে কিংবদন্তি গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্ট সেই স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন। ২৩টি অসমাধান সমস্যার একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন তিনি—যার মধ্যে ষষ্ঠটি ছিল সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী: পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক তত্ত্বগুলোর গাণিতিক ভিত্তি তৈরি করা।
এ যেন বিশাল এক সমুদ্র, যেখানে microscopic, mesoscopic এবং macroscopic—তিনটি স্তরে তরলের গতি ও আচরণ বোঝার চেষ্টা চলছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী। কিন্তু প্রতিটি স্তরেই ছিল অনিশ্চয়তা—এক স্তরের ব্যাখ্যা আরেকটিকে কতটা যুক্তিযুক্তভাবে ধারণ করে, তার নির্ভরযোগ্য প্রমাণ মেলেনি এতদিন।
অবশেষে সমাধান!
২০২৫ সালের মার্চে, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ ইউ ডেং এবং মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের জাহের হানি ও জিয়াও মা একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন arXiv.org-এ। তাঁরা দাবি করেন, তরলগতির তিনটি প্রধান তত্ত্ব—নিউটনের কণাভিত্তিক মডেল (microscopic), বোল্টজম্যান সমীকরণ (mesoscopic), এবং ইউলার ও নাভিয়ার-স্টোকস সমীকরণ (macroscopic)—এই তিনটিকে একসূত্রে গাঁথা সম্ভব হয়েছে। এটি শুধু একটি গণিত সমস্যার সমাধান নয়; এটি হলো পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি গঠনে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক।
তিনটি দৃষ্টিকোণ, একই বাস্তবতা
এই তিনটি তত্ত্ব তিনটি ভিন্ন মাত্রায় তরলের গতি বিশ্লেষণ করে। microscopic স্তরে, প্রতিটি কণার গতি আলাদাভাবে হিসেব করা হয় নিউটনের নিয়ম দিয়ে। mesoscopic স্তরে, বোল্টজম্যানের সমীকরণ শত শত কণার গড় আচরণ বিশ্লেষণ করে। আর macroscopic স্তরে, তরলকে একটি ধারাবাহিক পদার্থ হিসেবে ধরে ইউলার ও নাভিয়ার-স্টোকস সমীকরণ ব্যবহার করা হয়। এই সমীকরণ দুটি আধুনিক বিমানের নকশা থেকে শুরু করে আবহাওয়ার পূর্বাভাস পর্যন্ত বহু প্রয়োগে ব্যবহৃত হয়।
তত্ত্বগুলো বাস্তবজগতের একই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করলেও, তাদের মধ্যে গাণিতিক সেতুবন্ধন এতদিন ছিল অনুপস্থিত। হিলবার্টের স্বপ্ন ছিল এই স্তরগুলো যেন একটি থেকে আরেকটিতে যৌক্তিকভাবে রূপান্তরিত হয়।
গণিতের সেতু তৈরি করলেন ডেং, হানি ও মা
গবেষকরা প্রথমে microscopic স্তর থেকে mesoscopic স্তরে গমনের প্রক্রিয়ায় দেখান, কিভাবে অসীম সংখ্যক কণার আচরণ গড় হিসেবে বোল্টজম্যান সমীকরণে প্রকাশ পায়। এরপর mesoscopic স্তর থেকে macroscopic স্তরে যাত্রা করেন, যেখানে গড় আচরণ তরলের বৃহৎ গতির সমীকরণে রূপ নেয়।
তাঁদের অন্যতম অবদান হলো দীর্ঘ সময়সীমার উপর গাণিতিক বিশ্লেষণ। পূর্বের গবেষণাগুলো শুধুমাত্র স্বল্প সময়ের জন্য এই রূপান্তরকে বৈধ প্রমাণ করতে পেরেছিল। কিন্তু বাস্তব তরল তো মুহূর্তিক নয়—বহু সংঘর্ষ, বহু ইতিহাস, বহু কণার গতিপথ মিলে একেকটি প্রবাহ গড়ে ওঠে। সেই ইতিহাসের প্রভাব হিসেব করে গবেষকরা দেখিয়েছেন, সময়ের সাথে সাথে সংঘর্ষের প্রভাবও সীমিত থেকে যায় এবং মূল সমীকরণের সঙ্গে অসঙ্গতি তৈরি করে না।
বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া
“এটি বিশুদ্ধ গণিতের জয়যাত্রা, এবং একই সাথে পদার্থবিজ্ঞানের একটি স্বপ্নপূরণ,” মন্তব্য করেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ ড. লুসি হান্টার।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পাঠক, ছাত্র সাব্বির রহমান বলেন, “এই ধরনের গবেষণাই আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়, যেন আমরা নতুন কিছু ভাবতে শিখি। এটি শুধু জ্ঞান নয়, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও।”
শেষ কথা
এই সাফল্য শুধুমাত্র একটি গাণিতিক প্রমাণ নয়—এটি এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলা একটি দার্শনিক অনুসন্ধানের উত্তর। ডেভিড হিলবার্ট যেখান থেকে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবতার ভিত্তিতে রূপ পেল ডেং, হানি ও মার হাতে।
এখন প্রশ্ন হলো—হিলবার্টের বাকি সমস্যাগুলো কি এমনভাবেই সমাধান হবে? ইতিহাসের পাতায় আজ লেখা হলো এক নতুন অধ্যায়, যা আমাদের আশা জাগায়—গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও কল্পনার সম্মিলনে জ্ঞান জয়ের নতুন রূপকথা সম্ভব।
Leave a comment