বাংলাদেশের খুলনা থেকে উঠে আসা তিন বন্ধু বর্তমানে ঢাকাতে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে —শাহরিয়ার, আনিকা ও সাদমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে পড়লেও এদের চোখে মুখে এক ধরনের অনিশ্চয়তা। কেন? কারণ তারা দেখছে, দেশে বিজ্ঞান চর্চা আর প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কম। এক বিকেলবেলা ক্যাম্পাসের চায়ের দোকানে বসে শাহরিয়ার এক জিজ্ঞাসা ছুঁড়ে দিল—“তুমি কি জানো, আমাদের দেশে বড় কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার কেন হয় না?”
আনিকা তার প্রশ্নের উত্তরে বলল, “আমাদের গবেষণাগুলো কি আদৌ আন্তর্জাতিক মানের? অনেক ল্যাবে এখনো আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। তাছাড়া, প্রয়োজনীয় তহবিলও তো নেই।”
সাদমান সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলল, “২০২৩ সালে প্রকাশিত Global Innovation Index অনুযায়ী, আমরা উদ্ভাবনে ১৩২টি দেশের মধ্যে ১০২তম। এর মধ্যে ভারত রয়েছে ৪০তম স্থানে, আর সিঙ্গাপুর ৭তম। এই পার্থক্য আমাদের জন্য লজ্জাজনকই বলতে হবে।”
বাংলাদেশের গবেষণা ও উদ্ভাবন সংকট
আনিকার মত অমূলক নয়। গবেষণা-বিষয়ক সরকারি খাতিরের তথ্যমতে, বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ০.৩৭%। উন্নত অনেক দেশে এটি ২-৩% বা তারও বেশি। গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত পরিকাঠামো ও অর্থায়ন না থাকায় শিক্ষকেরা প্রাথমিকভাবে ক্লাসরুম শিক্ষাতেই সীমিত থাকতে বাধ্য হন। ফেলে রাখা হয় গবেষণার বিশাল সুযোগ ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রগুলো।
শাহরিয়ার তখন প্রশ্ন তুলল, “সত্যি বলতে কি, আমরা তো অনেকেই জানি না STEM (Science, Technology, Engineering, Mathematics) শিক্ষায় দেশের অবস্থা কোথায়? Times Higher Education র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষ ১০০০-এর মধ্যে নেই। তাহলে বিশ্বমানের গবেষণা কীভাবে হবে?”
সাদমান যুক্তি দেয়, “গবেষণা তো কেবল পেপার পাবলিশ করার জন্য নয়, বাস্তব জীবনে তার প্রয়োগও জরুরি। আমাদের এখানে শিক্ষা-শিল্পের সংযোগ নেই বললেই চলে। অনেক শিক্ষার্থী স্নাতক শেষ করে প্রকৃত সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন করতে পারে না।”
কোথায় সমস্যা?
১. গবেষণা তহবিলের অভাব: দেশের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য বড় পরিমাণে বরাদ্দ থাকা চাই, যা বর্তমানে অপ্রতুল। উন্নত দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিটি গবেষণাগারে ২০-৫০ কোটি ডলার পর্যন্ত বরাদ্দ থাকে, আর বাংলাদেশে সেটি মাত্র কয়েক কোটি টাকায় সীমিত।
২. মানসম্পন্ন শিক্ষা ও র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে থাকা: Times Higher Education র্যাংকিং অনুযায়ী বাংলাদেশ শীর্ষ ১০০০-এর মধ্যেও নেই। এর ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের বিজ্ঞানের অবস্থান দুর্বল থেকে যায়।
৩. শিক্ষা-শিল্প সংযোগের অভাব: শুধুমাত্র পেপার পাবলিশ করলে হবে না, সেগুলোকে বাস্তবপ্রয়োগে নিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশে এখনো শিল্প খাত ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কার্যকর পার্টনারশিপ গড়ে ওঠেনি।
সমাধানের সম্ভাবনা: কী করা যেতে পারে?
আনিকা বলল, “আমরা কি সিঙ্গাপুরের মতো মডেল অনুসরণ করতে পারি না? তারা তো ৫০ বছর আগেও আমাদের মতোই পিছিয়ে ছিল। এখন কিন্তু তারা গবেষণায় বিশ্বসেরা।”
- গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো: গবেষণায় জিডিপির কমপক্ষে ১% বরাদ্দ রাখা উচিত। এতে পরবর্তী ১০ বছরে গবেষণা ও উদ্ভাবনে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনা সম্ভব।
- বিশ্ববিদ্যালয়-শিল্প সংযোগ গড়ে তোলা: উন্নত দেশে যেমন ল্যাবগুলো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করে, বাংলাদেশেও এই সংস্কৃতি চালু করা জরুরি। এতে বাস্তব সমস্যার সমাধান ও উদ্ভাবন সম্ভব হবে।
- উদ্ভাবনী প্রতিযোগিতা ও স্টার্টআপ ফান্ডিং: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে STEM বিষয়ক ইনকিউবেটর, হ্যাকাথন ও স্টার্টআপ ফান্ড তৈরি করতে হবে, যাতে তরুণরা নিজস্ব উদ্ভাবন নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে।
- আধুনিক কারিকুলাম ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে AI, Robotics, Data Science-এর মতো আধুনিক বিষয়গুলো কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। পাশাপাশি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও ডিজিটাল লাইব্রেরি বাড়িয়ে তুলতে হবে।
আশার আলো
রাত বাড়লেও শাহরিয়ার, আনিকা ও সাদমান থেমে থাকেনি। তাদের বিশ্বাস, নতুন প্রজন্ম যদি গবেষণাকে গুরুত্ব দেয়, উদ্যোগী হয়ে শেখে, দক্ষতা বিকাশে সঠিক ব্যবস্থা নেয়, তাহলে STEM শিক্ষায় বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।
উপসংহার
প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশে STEM শিক্ষার উন্নয়ন কোনো অসাধ্য ব্যাপার নয়। প্রয়োজন যথাযথ বরাদ্দ, কার্যকর নীতি, সচেতন শিক্ষার্থী ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের সমন্বয়। উদ্ভাবন আর গবেষণা বাড়লে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে, উন্নত প্রযুক্তির রপ্তানি সম্ভব হবে এবং সারা বিশ্বে আমাদের মেধার স্বাক্ষর ছড়িয়ে পড়বে।
আপনি কী ভাবছেন? বাংলাদেশের STEM শিক্ষার উন্নতির জন্য আপনি কী করতে চান? সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারলেই বাংলাদেশ একদিন উদ্ভাবনের কেন্দ্র হয়ে উঠবে—কারণ সত্যিই, STEM ছাড়া ভবিষ্যৎ নেই।
Leave a comment