কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

স্বাস্থ্যসেবায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বনাম ডাক্তার

Share
Share

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (AI, Artificial Intelligence) এবং স্বাস্থ্যসেবায় এর ভূমিকা নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক আলোচনা চলছে। প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ এবং AI-এর অসাধারণ দক্ষতার কারণে অনেকে মনে করেন যে, কৃ্ত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিগগিরই ডাক্তারদের প্রতিস্থাপন করতে পারবে। তবে, বাস্তবতা কি সত্যিই এমন? যদিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে, যেমন নির্ভুল রোগ নির্ণয় এবং দ্রুত ডেটা বিশ্লেষণ, এটি কি আসলেই ডাক্তারদের চেয়ে ভালো করতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আমাদের আজকের আলোচনা।

স্বাস্থ্যসেবায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ

নির্ভুল রোগ নির্ণয়: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’র পারদর্শিতা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সবচেয়ে বড় শক্তির একটি হল নির্ভুল রোগ নির্ণয়। বিশেষত, মেডিক্যাল ইমেজিংয়ের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কর্মক্ষমতা উল্লেখযোগ্য। এক্স-রে, এমআরআই, এবং সিটি স্ক্যান বিশ্লেষণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দক্ষতা প্রমাণিত হয়েছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্দিষ্ট ধরণের স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ে প্রায় ৯৪% সঠিক ভাবে নির্ণয় করতে পেরেছে, যেখানে মানব চিকিৎসকদের নির্ভুলতা ছিল প্রায় ৮৮% ।

আবার, চোখের রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সিস্টেমগুলো চোখের ছবির ভিত্তিতে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে, যা একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে প্রায় ৯৭% পর্যন্ত নির্ভুলতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে ।

গতি এবং দক্ষতা: দ্রুত ডেটা প্রক্রিয়াকরণ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আরেকটি বড় সুবিধা হল এর গতি এবং দক্ষতা। প্রচুর পরিমাণে ডেটা বিশ্লেষণ করতে এবং তা থেকে সিদ্ধান্ত নিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, করোনাভাইরাস মহামারির সময়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি দ্রুত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। বিশেষত, চীনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ভিত্তিক স্ক্যানিং সিস্টেমগুলি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সঠিক ফলাফল প্রদান করতে সক্ষম হয়েছিল, যেখানে মানব চিকিৎসকদের জন্য এটি বেশ সময়সাপেক্ষ ছিল ।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সীমাবদ্ধতা

সামগ্রিক বোঝার অভাব

যদিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে দক্ষ, এটি রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্য বুঝতে এবং জটিল পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম নয়। একজন ডাক্তার শুধু পরীক্ষার ফলাফলের উপর নির্ভর করেন না; তিনি রোগীর পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস, জীবনযাত্রার ধরন, মানসিক অবস্থা, এবং অন্যান্য পারিপার্শ্বিক বিষয় বিবেচনা করেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই দক্ষতা নেই। এটি একটি নির্দিষ্ট সমস্যা বা লক্ষণের জন্য ডেটা বিশ্লেষণ করতে পারে, কিন্তু রোগীর সামগ্রিক অবস্থা বোঝা এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পক্ষে এখনও সম্ভব নয়।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, জটিল এবং বিরল রোগ নির্ণয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ত্রুটির হার প্রায় ৩০% পর্যন্ত হতে পারে, যেখানে মানব চিকিৎসকদের ত্রুটির হার ছিল ১০%-এর নিচে । এটি প্রমাণ করে যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখনও মানব চিকিৎসকদের প্রতিস্থাপন করার মতো অবস্থায় নেই।

নৈতিক ও আবেগগত দিক: মানবিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা

স্বাস্থ্যসেবায় নৈতিক এবং আবেগগত দিকগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন রোগীর জন্য ডাক্তার শুধু রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা প্রদানকারী নন; তিনি একজন উপদেষ্টা, একজন সমর্থক, এবং একজন বন্ধুর মতো। রোগীর সাথে মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করা একজন চিকিৎসকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মধ্যে এই ধরনের মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলার সক্ষমতা নেই।

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৮৫% রোগী তাদের চিকিৎসার সময় মানব চিকিৎসকদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পছন্দ করে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে পরিচালিত চিকিৎসার প্রতি তাদের আস্থা কম থাকে । এটি স্পষ্ট করে যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যতই উন্নত হোক না কেন, মানবিক আবেগ এবং সহানুভূতি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এটি ডাক্তারদের প্রতিস্থাপন করতে পারবে না।

স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় ডাক্তারদের অপরিহার্য ভূমিকা

সামগ্রিক রোগীর চিকিৎসা এবং সমন্বিত পদ্ধতির গুরুত্ব

একজন ডাক্তার যখন একজন রোগীর চিকিৎসা করেন তখন একটি নির্দিষ্ট রোগ নির্ণয়েই মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন না; তিনি রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্যে পর্যালোচনা করে দেখেন এবং আনুসঙ্গিক সমস্ত কিছূর উপরই নজর রাখেন। একজন রোগীর শারীরিক, মানসিক, এবং সামাজিক স্বাস্থ্য সহ সমস্ত দিক বিবেচনা করে চিকিৎসকরা একটি পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করেন। এটি কেবলমাত্র একজন দক্ষ চিকিৎসকের দ্বারাই সম্ভব।

উদাহরণস্বরূপ, একজন ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে, চিকিৎসক কেবলমাত্র তার ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণেই সীমাবদ্ধ থাকেন না; তিনি রোগীর খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক কার্যক্রম, মানসিক অবস্থা, এবং পারিবারিক ইতিহাসকেও বিবেচনা করেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই ধরনের একটি সমন্বিত পদ্ধতি নিতে সক্ষম নয়।

অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ: মানবিক অন্তর্দৃষ্টি

মানব চিকিৎসকদের আরেকটি বড় সুবিধা হল তাদের অভিজ্ঞতা এবং অন্তর্দৃষ্টি। অনিশ্চিত এবং বিরল পরিস্থিতিতে একজন চিকিৎসক তার অভিজ্ঞতা এবং প্রজ্ঞার মাধ্যমে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মধ্যে এই ধরনের গুণ, ফিচার বা ক্ষমতা নেই।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অনিশ্চিত রোগ নির্ণয়ে মানব চিকিৎসকদের সাফল্যের হার প্রায় ৭০%, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাফল্যের হার ছিল প্রায় ৪৫% । এটি প্রমাণ করে যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চেয়ে মানব চিকিৎসকদের অন্তর্দৃষ্টি এবং অভিজ্ঞতা আরও কার্যকর।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডাক্তারদের পরিপূরক ভূমিকা: একটি সমন্বিত পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা

নির্ণয় ক্ষমতা বাড়ানো: সহযোগী পদ্ধতির গুরুত্ব

যদিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ডাক্তারদের প্রতিস্থাপন করতে পারবে না, এটি অবশ্যই ডাক্তারদের কাজকে সহজ করতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রোগ নির্ণয়ের নির্ভুলতা বাড়াতে, খরচ এবং সময় সাশ্রয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় একজন ডাক্তার দ্রুত নির্ণয় করতে এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু করতে পারেন। এটি শুধুমাত্র রোগীর জন্যই নয়, চিকিৎসা ব্যবস্থার সামগ্রিক দক্ষতা বৃদ্ধিতেও সহায়ক।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডাক্তারদের সহযোগী মডেল ব্যবহার করে নির্ণয়ের সঠিকতা প্রায় ৯৮% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে । এটি দেখায় যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডাক্তারদের একত্রিত কাজের মাধ্যমে সর্বোত্তম ফলাফল পাওয়া সম্ভব।

কর্মভার কমানো এবং বার্নআউট প্রতিরোধ: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তা

ডাক্তারদের উপর অনেক চাপ থাকে, যা বার্নআউট বা অবসাদের কারণ হতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে রুটিন কাজগুলো পরিচালনা করা গেলে ডাক্তারদের উপর থেকে চাপ কমানো যায় এবং তারা আরও জটিল কেসগুলিতে মনোনিবেশ করতে পারেন। উদাহরণ সরূপ একজন চিকিৎসককে রোগীর বিভিন্ন তথ্য এবং সিদ্ধান্ত সমূহ সিস্টেমে লিপিবদ্ধ করতে হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিয়ে ভয়েস টাইপিং কিংবা ChatGPT ব্যবহার করে এই কাজটি সহজে এবং দ্রুততার সাথে করা যায়।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় ডাক্তারদের বার্নআউটের হার প্রায় ২০% পর্যন্ত কমানো সম্ভব হয়েছে । এটি স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে।

উপসংহার

এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারলাম যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) স্বাস্থ্যসেবায় ডাক্তারদের প্রতিস্থাপন করতে পারবে না। যদিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করছে, যেমন নির্ভুল রোগ নির্ণয় এবং দ্রুত ডেটা বিশ্লেষণ, এটি মানুষের চিকিৎসকদের প্রতিস্থাপন করার মতো অবস্থায় নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হল এটি রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্য বুঝতে এবং জটিল পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম নয়।

তবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডাক্তারদের মধ্যে একটি সমন্বিত পদ্ধতি গ্রহণ করা হলে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত হতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ডাক্তারদের নির্ণয় ক্ষমতা বাড়াতে এবং কর্মভার কমাতে সহায়ক হতে পারে। তবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতিও গুরুত্বপূর্ণ, এবং ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

সর্বশেষে, আমরা বলতে পারি যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডাক্তারদের মধ্যে একটি সহযোগী পদ্ধতির মাধ্যমে সর্বোত্তম স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা সম্ভব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় ডাক্তারদের কাজ সহজ করা যায়, তবে মানবিক অনুভূতি এবং নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করার জন্য চিকিৎসকদের অপরিহার্যতা কখনোই ফিকে হবে না।

স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটি শুধুমাত্র একটি সহায়ক হাতিয়ার বা টুলস হিসেবে কাজ করতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মানব চিকিৎসকদের মধ্যে একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হলে আমরা একটি উন্নত এবং কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব।

Share
Written by
ড. মশিউর রহমান

ড. মশিউর রহমান বিজ্ঞানী.অর্গ এর cofounder যার যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৬ সনে। পেশাগত জীবনে কাজ করেছেন প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী ও শিক্ষক হিসাবে আমেরিকা, জাপান, বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরে। বর্তমানে তিনি কাজ করছেন ডিজিটাল হেল্থকেয়ারে যেখানে তার টিম তথ্যকে ব্যবহার করছেন বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবার জন্য। বিস্তারিত এর জন্য দেখুন: DrMashiur.com

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org