বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের দেশে নতুন গবেষকদের জন্য গবেষণা শুরু করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে ইচ্ছা, ধৈর্য, এবং সঠিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে এটি সম্ভব। বিশেষত যাঁরা তহবিল, গবেষণাগার সুবিধা, বা তত্ত্বাবধায়কের অভাবে আটকে আছেন, তাঁদের জন্য কিছু কার্যকর উপায় ও পরামর্শ তুলে ধরা হলো:
গবেষণার শুরুতে যা করবেন
গবেষণায় প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো আগ্রহের ক্ষেত্র নির্ধারণ করা। আপনি কোন বিষয়ে গবেষণা করতে চান, সেটি সুনির্দিষ্ট করুন। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার আগ্রহ জীববিজ্ঞান, ডাটা সায়েন্স, বায়োইনফরমেটিক্স, ক্লাইমেট চেঞ্জ, এগ্রিকালচার, বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে থাকে তাহলে সেই বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র পড়া শুরু করুন। Google Scholar, PubMed, এবং ResearchGate-এর মতো প্ল্যাটফর্ম থেকে ফ্রি এবং ওপেন অ্যাকসেস গবেষণাপত্র ডাউনলোড করা সম্ভব। নতুন গবেষকদের জন্য আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ছোট ছোট বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করা। গবেষণার ক্ষেত্রে বড় চিন্তা করা ভালো, তবে শুরুতে বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে ছোট প্রকল্প শুরু করে গবেষণার কৌশল ও পদ্ধতি শিখুন। এরপর ধীরে ধীরে বড় প্রকল্পে নিজেকে যুক্ত করুন।
গবেষণার জন্য তহবিল এবং গবেষণাগার না থাকলে কী করবেন
বাংলাদেশের মতো দেশে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল পাওয়া চ্যালেঞ্জ হতে পারে, তবে এর মানে এই নয় যে গবেষণা শুরু করা অসম্ভব। প্রথমদিকে গবেষণার জন্য বড় আকারের আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন নেই। বিশেষত, ডেটা-বেইজড বা in silico গবেষণা করার জন্য আপনার প্রয়োজন শুধুমাত্র একটি কম্পিউটার এবং একটি ইন্টারনেট সংযোগ। বিশেষ করে, যারা জীববিজ্ঞান বা জেনেটিক্স নিয়ে গবেষণা করতে চান, তাদের জন্য পাবলিক ডেটাবেস বিশ্লেষণ একটি দারুণ বিকল্প হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি NCBI, GEO, TCGA, Ensembl, এবং KEGG-এর মতো ডেটাবেস থেকে জেনোমিক বা প্রোটোমিক ডেটা সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করে নতুন এবং মানসম্পন্ন গবেষণা তৈরি করতে পারেন। এছাড়া, সামাজিক বিজ্ঞান, অর্থনীতি, বা জনস্বাস্থ্য-এর মতো ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ডেটা পাবলিক ডেটাবেস থেকে পাওয়া যায়, যেমন World Bank, UNICEF, বা WHO-এর ডেটাবেস। এই ডেটাগুলো বিশ্লেষণ করার জন্য আপনি R বা Python-এর মতো ফ্রি সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারেন এবং এই সফটওয়্যার ব্যবহার শিখতে YouTube এবং Coursera-এর মতো প্ল্যাটফর্মে প্রচুর বিনামূল্যের কোর্স রয়েছে। Mathematical modeling বা simulation-based research-এর ক্ষেত্রে ও কোনো গবেষণাগারের প্রয়োজন হয় না। আপনি ক্লাইমেট মডেলিং, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ, বা ডিজিটাল সিগন্যাল প্রসেসিং-এর মতো কাজগুলো শুধুমাত্র সফটওয়্যার ব্যবহার করেই করতে পারেন।
তত্ত্বাবধায়কের অভাবে কী করবেন
তত্ত্বাবধায়কের অভাব থাকলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আপনার আগ্রহের বিষয়ে আন্তর্জাতিক গবেষকদের গবেষণা পড়ুন। এরপর তাঁদের সাথে ইমেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করুন। ইমেইল করার সময় সংক্ষিপ্ত, বিনয়ী, এবং স্পষ্ট হোন। LinkedIn এবং ResearchGate ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক গবেষকদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, কারণ অনেক গবেষক নতুনদের সাহায্য করতে আগ্রহী। যদি একজন সাড়া না দেন, তাহলে হতাশ না হয়ে অন্য কারো কাছে সাহায্য চাইতে পারেন। কখনওই সাহায্য চাওয়ার জন্য দ্বিধাগ্রস্ত হবেন না। যদি আপনার ভালো আইডিয়া থাকে এবং এটি বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী হন, তাহলে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ আপনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে।
গবেষণার ফলাফল প্রকাশ
আপনার গবেষণার ফলাফল প্রকাশে তহবিলের অভাব হলে, উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। অনেক জার্নাল রয়েছে, যারা উন্নয়নশীল দেশের গবেষকদের জন্য প্রকাশনা ফি মওকুফ করে। এর মধ্যে Research4Life হলো একটি বিশেষ বৈশ্বিক উদ্যোগ, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর গবেষক, শিক্ষক এবং নীতিনির্ধারকদের জন্য বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত, চিকিৎসা এবং সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণা প্রবন্ধ এবং তথ্য বিনামূল্যে বা সাশ্রয়ী মূল্যে সরবরাহ করে। তবে অবশ্যই ফলাফল প্রকাশের আগে আপনার গবেষণাপত্রের মান যাচাই করতে অভিজ্ঞ কারও পরামর্শ নিন।
অর্থ ব্যয় ছাড়াই গবেষণা শেখার কার্যকর উপায়
গবেষণার জগতে প্রবেশ করার জন্য আজকের প্রযুক্তিনির্ভর সময়ে অসংখ্য ফ্রি রিসোর্স আপনার জন্য উন্মুক্ত। অনলাইনে Coursera, edX, FutureLearn, এবং MIT OpenCourseWare-এর মতো প্ল্যাটফর্ম থেকে গবেষণা পদ্ধতি শেখার বিনামূল্যের কোর্স পাওয়া যায়। এসব প্ল্যাটফর্মে গবেষণার মৌলিক ধারণা, ডেটা বিশ্লেষণ, এবং বিভিন্ন গবেষণা কৌশল সম্পর্কে শেখা সম্ভব। ফেসবুকের বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপেও ফ্রি সেমিনার, ওয়ার্কশপ এবং পডকাস্টের মাধ্যমে নতুন দক্ষতা অর্জনের দারুণ সুযোগ রয়েছে। তবে ফেসবুক বা অন্য কোনো সোশ্যাল মিডিয়ায় পেইড কোর্সে অর্থ ব্যয় করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বেশিরভাগ পেইড কোর্স এমন বিষয় শেখায়, যা ইন্টারনেটে বিনামূল্যে সহজেই পাওয়া যায়। এটা মনে রাখা জরুরি যে যাঁরা এসব পেইড কোর্স পরিচালনা করেন, তাঁরাও একসময় বিনামূল্যে বিভিন্ন রিসোর্স থেকে শেখার মাধ্যমে নিজেদের দক্ষতা উন্নত করেছেন। তাই বিনামূল্যের রিসোর্স ব্যবহার করাই বেশি ফলপ্রসূ। এছাড়াও, YouTube হলো গবেষণা পদ্ধতি শেখার আরেকটি বড় মাধ্যম। এখানে ডেটা বিশ্লেষণ, গবেষণার বেসিক ধারণা এবং প্রায় সব বিষয়ে অসংখ্য টিউটোরিয়াল ভিডিও পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক কনফারেন্স ও ওয়ার্কশপগুলোতেও অংশ নেওয়ার চেষ্টা করুন। অনেক সময় এসব ইভেন্টের ফি মওকুফের সুযোগ থাকে, যা নতুন গবেষকদের জন্য একটি বড় সুবিধা। নিজের আগ্রহ ধরে রেখে বিনামূল্যে শেখার এই সুযোগগুলো কাজে লাগান।
আত্মবিশ্বাস ও একাগ্রতা রাখুন
গবেষণা একটি দীর্ঘমেয়াদী এবং ধৈর্যশীল প্রক্রিয়া। এটি শুধু সময়ের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং এর জন্য প্রয়োজন সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, পরিশ্রম এবং একাগ্রতা। অনেক সময় সীমিত তহবিল বা উপকরণের অভাব হতে পারে, তবে এ কারণে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। গবেষণা সফল করার জন্য সঠিক পরিকল্পনা, সঠিক সময়ে বিনামূল্যের উৎস ব্যবহার এবং নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা যথেষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ে বা প্রাথমিক অবস্থায় অনেক বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রী কোনো গবেষণা অভিজ্ঞতা ছাড়াই বিদেশে গিয়ে সফল গবেষক হয়েছেন। তাদের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, সীমিত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও, কঠোর পরিশ্রম, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলে আপনি যে কোনো প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে পারবেন। নতুন গবেষকদের জন্য পরামর্শ: কখনো হতাশ হবেন না। আপনার কাজের প্রতি বিশ্বাস রাখুন এবং আপনার লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। যেকোনো পরিস্থিতিতেই সুযোগ তৈরি হয়, যদি আপনার একাগ্রতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক থাকে।
ড. আজিজুল হক, সহকারী অধ্যাপক, Yeungnam University, দক্ষিণ কোরিয়া।
ইমেইল: [email protected]
Leave a comment