অন্যান্য

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের নতুন দিগন্ত: NSU Center of Quantum Computing (NCQC)

Share
Share

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। এই অগ্রগতির সারথি হতে বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে এক দারুণ উদ্যোগ। সম্প্রতি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (NSU) প্রতিষ্ঠা করেছে এনএসইউ সেন্টার অফ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং (NSU Center of Quantum Computing)। এই কেন্দ্রটি শুধু গবেষণার নতুন ক্ষেত্রই উন্মোচন করবে না, বরং দেশের প্রযুক্তি খাতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।

কোয়ান্টাম কম্পিউটিং সেন্টার কী এবং এর কার্যক্রম

এনএসইউ সেন্টার অফ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং হলো একটি বিশেষায়িত গবেষণা ও শিক্ষা কেন্দ্র, যা কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের অত্যাধুনিক শাখা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নিয়ে কাজ করবে। এই কেন্দ্রের ডিরেক্টর হলেন ডঃ মাহদী রহমান চৌধুরী। এই কেন্দ্রের প্রাথমিক লক্ষ্য হলো দেশের তরুণ প্রজন্মকে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের প্রতি আগ্রহী করে তোলা এবং তাদের এই বিষয়ে জ্ঞান অর্জনে অনুপ্রাণিত করা।

সাধারণভাবে, একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটিং সেন্টারের কাজ বহুমুখী হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • তাত্ত্বিক গবেষণা: কোয়ান্টাম অ্যালগরিদম, কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফি, কোয়ান্টাম যোগাযোগ এবং কোয়ান্টাম মেশিন লার্নিংয়ের মতো ক্ষেত্রগুলোতে নতুন ধারণা ও মডেল তৈরি করা।
  • পরীক্ষামূলক কাজ: কোয়ান্টাম কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার তৈরি ও উন্নত করা, কোয়ান্টাম বিট (কিউবিট) স্থিতিশীল রাখা এবং কোয়ান্টাম গণনা প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে কাজ করা।
  • শিক্ষাদান ও প্রশিক্ষণ: শিক্ষার্থী ও গবেষকদের জন্য কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের উপর কোর্স, সেমিনার এবং কর্মশালার আয়োজন করা।
  • শিল্প সহযোগিতা: বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাথে কোয়ান্টাম প্রযুক্তির ব্যবহারিক অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে কাজ করা।

এনএসইউ সেন্টার অফ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রাথমিকভাবে কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফি (Quantum Cryptography), কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন (Quantum Communication), কোয়ান্টাম মেশিন লার্নিং (Quantum Machine Learning), এবং কোয়ান্টাম অ্যালগরিদম (Quantum Algorithm) নিয়ে তাত্ত্বিক গবেষণা পরিচালনা করবে। ভবিষ্যতে পরীক্ষামূলক কাজের দিকেও এগিয়ে যাওয়ার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়াও, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সেমিনার এবং কর্মশালার আয়োজন করে জ্ঞান বিতরণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের জন্য এর গুরুত্ব অপরিসীম

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই ধরনের একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর কারণগুলো হলো:

  • প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতা: কোয়ান্টাম প্রযুক্তি ভবিষ্যৎ বিশ্বের মেরুদণ্ড হতে চলেছে। এই কেন্দ্রে গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে নিজেদের স্বনির্ভর করতে পারবে এবং বিশ্ব প্রযুক্তির দৌড়ে শামিল হতে পারবে।
  • মেধা বিকাশ ও কর্মসংস্থান: দেশের মেধাবী শিক্ষার্থী ও গবেষকদের কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো উচ্চতর গবেষণায় অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হবে। এর ফলে আন্তর্জাতিক মানের গবেষক তৈরি হবে এবং দেশে উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
  • অর্থনৈতিক প্রভাব: কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের অ্যাপ্লিকেশনগুলো বিভিন্ন শিল্প যেমন ঔষধ উৎপাদন, ব্যাংকিং ও অর্থব্যবস্থা, প্রতিরক্ষা, রসায়ন এবং কৃষিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। বাংলাদেশে এই গবেষণা কেন্দ্র ভবিষ্যতে এসব খাতে নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করবে এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হবে।
  • আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি: এই কেন্দ্র আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সহযোগিতার পথ খুলে দেবে, যা দেশের জন্য নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তির আদান-প্রদানে সহায়ক হবে এবং বাংলাদেশকে বিশ্ব কোয়ান্টাম গবেষণার মানচিত্রে তুলে ধরবে।

কীভাবে সবাই উপকৃত হতে পারে?

এনএসইউ সেন্টার অফ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং থেকে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপকৃত হতে পারবে:

  • শিক্ষার্থী ও গবেষকগণ: এই কেন্দ্রের সেমিনার, কর্মশালা, বিশেষায়িত কোর্স এবং গবেষণা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের গভীর জ্ঞান ও বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে। এটি তাদের ভবিষ্যৎ পেশাগত জীবনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবে।
  • শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান: এই কেন্দ্রের গবেষণা ফলাফল এবং উদ্ভাবনগুলো বিভিন্ন শিল্প খাতে নতুন পণ্য ও সেবা উন্নয়নে সহায়তা করতে পারে। বিশেষত, ডেটা নিরাপত্তা, অপ্টিমাইজেশন এবং মেশিন লার্নিংয়ের মতো ক্ষেত্রগুলোতে কোয়ান্টাম প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিল্পগুলো তাদের কার্যক্রমকে আরও দক্ষ ও সুরক্ষিত করতে পারবে।
  • সাধারণ মানুষ: যদিও সরাসরি নয়, তবে কোয়ান্টাম প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলস্বরূপ উন্নত সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা, দ্রুততর ও কার্যকর ঔষধ আবিষ্কার, পরিবেশবান্ধব নতুন উপকরণ তৈরি এবং আরও উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে সাধারণ মানুষ পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে।
  • নীতি নির্ধারকগণ: কোয়ান্টাম প্রযুক্তির সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে সঠিক এবং হালনাগাদ জ্ঞান লাভে সাহায্য করবে, যা ভবিষ্যতের জাতীয় প্রযুক্তি নীতি এবং গবেষণা ও উন্নয়নের অগ্রাধিকার প্রণয়নে সহায়ক হবে।

অনুপ্রেরণার উৎস এবং সম্ভাব্য প্রভাব

এই কেন্দ্রটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গবেষণা কেন্দ্রগুলোর জন্য একটি অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করবে। ডিরেক্টর ডঃ মাহদী রহমান চৌধুরী-এর দূরদর্শী নেতৃত্বে এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সম্মানিত উপাচার্য (VC) ডঃ আব্দুল হান্নান চৌধুরী ও স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সেস (SEPS)-এর ডিন ডঃ সাজ্জাদ হোসেন নিরলস পৃষ্ঠপোষকতায় এই কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপের প্রমাণ। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো না।

এই ধরনের একটি কেন্দ্রের সম্ভাব্য প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:

  • কোয়ান্টাম ইকোসিস্টেম তৈরি: বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী কোয়ান্টাম প্রযুক্তি ইকোসিস্টেম গড়ে উঠতে পারে, যেখানে গবেষক, ডেভেলপার, স্টার্টআপ উদ্যোক্তা এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান একসাথে কোয়ান্টাম প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও প্রয়োগে কাজ করবে।
  • আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন: কোয়ান্টাম গবেষণায় বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগের নতুন দুয়ার খুলে দেবে।
  • ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রস্তুতি: এই কেন্দ্রটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রস্তুত করবে, যারা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম হবে এবং কোয়ান্টাম যুগের জটিল সমস্যাগুলো সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
  • জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা: কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফির মতো ক্ষেত্রগুলোতে গবেষণা দেশের সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও সুদৃঢ় করতে পারে, যা জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পরিশেষে বলা যায়, এনএসইউ সেন্টার অফ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং শুধু একটি গবেষণা কেন্দ্র নয়, এটি বাংলাদেশের জ্ঞানভিত্তিক সমাজে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এটি দেশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য অফুরন্ত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে, যা বাংলাদেশকে ২১ শতকের অগ্রগামী দেশগুলোর কাতারে স্থান করে নিতে সাহায্য করবে।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
অন্যান্য

🌟 কোয়ান্টাম এবং ডায়মন্ড: বিজ্ঞানের এক অভাবনীয় প্রেমকাহিনি

কল্পনা করুন—আপনার হাতের আংটির এক টুকরো খাঁটি ডায়মন্ড, কেবল সৌন্দর্যের প্রতীকই নয়,...

অন্যান্যকোয়ান্টাম কম্পিউটিংবিজ্ঞানীদের খবর

বাস্তবতার স্থপতি: ডেভিড ডয়েচ এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটারের স্বপ্নযাত্রা

ডেভিড ডয়েচ(David Deutsch), তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের পবিত্র আঙিনায় যাঁর নাম প্রায়শই ফিসফিস করে...

অন্যান্য

সবার জন্য শিক্ষা: সমতা, উন্নয়ন ও ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা

সবার জন্য শিক্ষা একটি শক্তিশালী, সচেতন এবং দক্ষ সমাজ গঠনের মূল ভিত্তি।...

অন্যান্য

দক্ষিণ কোরিয়ার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ!

লেখক- আজিজুল হক সহকারী অধ্যাপক, ইয়েংনাম বিশ্ববিদ্যালয়। দক্ষিণ কোরিয়ার শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টার্নশিপ...

অন্যান্যসাক্ষাৎকার

ড. আবুল কালাম আজাদ: ক্যান্সার গবেষণায় এক অগ্রণী পথিকৃৎ!

ড. আবুল কালাম আজাদ বর্তমান পদবী: রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, মেডিক্যাল মাইক্রোবায়োলজি এবং ইমিউনোলজি...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.