মহাবিশ্বকে যদি একটি খাদ্যের সাথে তুলনা করা হয়, তবে একে মাইক্রোওয়েভ পপকর্ণের একটি ব্যাগ হিসেবে কল্পনা করাই ভাল, যেখানে প্রতিটিদিকে তাপ এবং বিস্ফোরণের প্রচন্ড বিশৃঙ্খলা বিদ্যমান। নোভা, সুপারনোভা, হাইপারনোভা এসব নক্ষত্রিক বিস্ফোরণ মহাবিশ্বে হরহামেশাই ঘটতে দেখা যায় কিন্তু যখন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সমপূর্ণ ভিন্নরকম একটি বিস্ফোরণ আবিস্কার করে, তখন সেটাকে একপ্রকার বিরল ঘটনাই বলা চলে।
নোভা হল সেই নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণ যা একটি শ্বেত বামন তারকার বিদীর্ণ হবার ফলে ঘটে আর সুপারনোভা বিস্ফোরণ সেইসকল তারায় ঘটে যেসকল তারা ১.৪ সূর্যভরের চেয়ে বেশী ভরবিশিষ্ট। এ বছরের জুন মাসে নাসার হাবল স্পেস টেলিস্কোপ কিলোনোভা নামে একটি নতুন ধরনের নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণ শনাক্ত করেছে। নিউট্রন তারার মত দু’টি অধিক ঘনত্বের বস্তুর মধ্যে যখন সংঘর্ষ ঘটে তখন এ ধরনের বিস্ফোরণ ঘটতে দেখা যায় । হাবল একটি কিলোনোভা থেকে ম্রিয়মান অগ্নিগোলক পর্যবেক্ষন করেছিল। এরপরই, হাবল পৃথিবী থেকে চারশো কোটি আলোক বর্ষ দূরে একটি ক্ষুদ্র গামা রশ্নি বিস্ফোরণ লক্ষ্য করে । এই পর্যবেক্ষণ শেষ পর্যন্ত ক্ষুদ্র গামা রশ্নি বিস্ফোরণের রহস্য উম্মোচন করে বলে মনে করেন এ সংক্রান্ত গবেষনা পরিচালনাকারী গবেষনাদলের নেতৃত্বে থাকা যুক্তরাজ্যের লিষ্টার বিশ্ববিদ্যায়ের অধ্যাপক নীয়াল তানভীর ।
গামা রশ্নি বিস্ফোরণ হল উচ্চশক্তি বিকিরণের ফলে সৃষ্ট আভা বা স্ফুলিঙ্গ । গামা রশ্নি বিস্ফোরণের সময় মহাকাশের এ ধরণের স্ফুলিঙ্গের বিক্ষিপ্ত সঞ্চারন লক্ষ্য করা যায । এ স্ফুলিঙ্গ দুই ধরণের : কোনটি ছোট আর কোনটি র্দীঘ । অতি উচ্চভরবিশিষ্ট তারার বিধ্বস্ত হবার ফলে র্দীঘস্থায়ী গামা রশ্নি বিস্ফোরণ (২ সেকেন্ডের বেশী দীর্ঘস্থায়ী) উৎপন্ন হয় বলে ধারণা করা হয়। তানভীরের গবেষণাকারী দলসহ আরো অনেক জ্যের্তিবিজ্ঞানী এমন ধারনা পোষন করেন এবং এর পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ ইতোমধ্যে উপস্থাপন করেছেন । র্দীঘস্থায়ী গামা রশ্নি বিস্ফোরণ সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ধারনা যথেষ্ট স্বচ্ছ হলেও ক্ষুদ্র গামা রশ্নি বিস্ফোরণ এখোনো অনেক রহস্যময়।
যদিও নিউট্রন তারার মত নিরেট বস্তুসমূহের সংযোগের ফলে ক্ষুদ্র গামা রশ্মি বিস্ফোরন সংগঠিত হয় বলে ধারণা করা হত। কিন্তু এর সপক্ষে বিজ্ঞানীদের যথেষ্ট শক্তিশালী প্রমান ছিল না । হাবলের এই পর্যক্ষণের ফলে বিজ্ঞানীরা সুনির্দিষ্ট প্রমান উপস্থাপন করতে পেরেছেন ।
জোতিঃপদার্থ বিজ্ঞানীরা আগে থেকেই ধারণা করেছিলেন যে, একটি যুগ্ম ব্যাবস্থায় একজোড়া অতি ঘন নিউট্রন তারা পাক খাবার ফলে সল্পস্থায়ী গামা রশ্নি বিস্ফোরণ সৃষ্টি হয়। ব্যবস্থাটি মহাকর্ষীয় বিকিরন নিঃস্বরণ করার কারনেই এঘটনা ঘটে এবং এর ফলে স্থল-কাল কাঠামোতে ক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি হয় । ক্ষুদ্র তরঙ্গের মাধ্যমে শক্তি নিঃস্বরণের ফলে তারা দু,টি খুব দ্রুত পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসে । বিস্ফোরণের কয়েক মিলিসেকেন্ডে আগে তারা দ,টি একে অপরের দিকে পাক খায় এবং পরস্পরের সংস্পর্শে আসে। এর ফলে উচ্চতেজক্রিয় পদার্থ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এই তেজক্রিয় পদার্থগুলো উত্তপ্ত ও প্রসারিত হয়ে আলোকছটার নিঃসরন ঘটায়।
এভাবে উৎপন্ন কিলোনোভা উজ্জ্বলতা নিরিখে নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণসমূহের মধ্যম সন্তান। একটি নোভার চেয়ে ১০০০গুণ বেশী উজ্জ্বল হলেও এটি একটি সুপারনোভার উজ্জ্বলতার শুধুমাত্র ১/১০ অথবা ১/১০০ অংশ সৃষ্টি করে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল কেসিন একটি নতুন হিসাব উপস্থাপন করেন, যা কিলোনোভা দেখতে কেমন হবে সেটা বুঝতে বিজ্ঞানীদেরকে যথেষ্ট সাহায্য করে। যদিও তিনি এ সংক্রান্ত গবেষণায় যুক্ত ছিলেন না। কেসিন কিলোনোভার তাত্ত্বিক মডেল দাঁড় করানোর ব্যাপারে কাজ করছিলেন। তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে বিকিরন সৃষ্টিকারী উত্তপ্ত প্লাজমা দৃশ্যমান আলোক রশ্নি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে এবং কিলোনোভা হতে শক্তির ব্যাপক নিঃসরনের মাধ্যমে অবলোহিত আলোক রশ্মিকে কয়েকদিনের জন্য আচ্ছন্ন করে ফেলবে। তিনি বিজ্ঞানীদের পরামর্শ দেন, ‘‘এদেরকে শনাক্ত করতে হলে আপনাদের অবলোহিত বর্ণালীতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিত, যদিও এমনটি এর আগে কখনোই করা হয়নি।’’
আলোর অবলোহিত ব্যাপ্তিতে গামা রশ্মি বিস্ফোরণ খুঁজে পেতে এবং নিউট্রণ তারার বিস্ফোরণ থেকে বের হয়ে আসা ধ্বংসাবশেষ পর্যবেক্ষণ করার জন্য তানভীর হাবল টেলিস্কোপ ব্যাবহার করেছিলেন। এক সেকেন্ডের এক দশমাংশ সময় স্থায়ী হওয়ার পরেও জুনের ৩ তারিখ নাসার ক্ষীপ্রগতিসম্পন্ন টেলিস্কোপ এটা ধরতে সক্ষম হয় এবং এটা GRB1306030B নামে তালিকাভূক্ত হয়। অন্য গবেষণাদল থেকে প্রাপ্ত উপাত্তের একটি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ আবিস্কারটিকে নিশ্চিত করেছে। কেসিন এ পর্যবেক্ষণকে দুর্দান্ত পর্যবেক্ষণ বলে অভিহিত করেন, কেননা পর্যবেক্ষণলব্ধ বিস্ফোরণটি পৃথিবী থেকে অনেক দূরে এবং ক্ষণস্থায়ী। যা হোক, এর ফলে প্রমাণিত হয় যে, দু’টি বস্তুর একীভূত হবার কারণে সংগঠিত বিস্ফোরণের ফলে অবলোহিত দীপ্তির সৃষ্টি হয়েছে। আর এটাই হল কিলোনোভা। গবেষণার ফলাফল আগষ্টের ৩ তারিখ বিজ্ঞান সায়িকী ‘নেচার’ এর একটি বিশেষ অনলাইন প্রকাশনায় প্রকাশিত হয়েছিল।
বিশ্বব্রহ্মান্ডের মত বিশাল জায়গায়, নতুন ধরণের কোন মহাজাগতিক ঘটনার আবিস্কার খুবই কঠিন কিন্তু স্বাভাবিক। অনেক কিছুই আবিস্কার হয়েছে, তবুও হয়ত অনেক কিছুই অনাবিস্কৃত রয়ে গেছে। মহাবিশ্ব এমন একটা জায়গা, যেখানে আমাদের চমকে দেবার মত, আমাদের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করার মত জিনিসের অভাব নাই। তারই সামান্য একটি নমুনা কিলোনোভার আবিস্কার। মহাবিশ্ব তার নিঃসীম কালো অন্ধকার মহাকাশে অপার রহস্যের ভান্ডার নিয়ে আমাদের জন্য প্রতীক্ষা করে বসে আছে এবং আমাদের আহবান জানাচ্ছে, ‘‘এস মেধাবীর দল এসো, এস অনুসন্ধিৎসুর দল এসো। খুঁজে বের কর আমার সকল রহস্য; বুদ্ধি, মেধা আর পরিশ্রমের বলে জিতে নাও সকল রহস্যের সমাধান।’’ কে জানে পরবর্তীতে মহাবিশ্ব আর কোন রহস্যের দুয়ার উন্মোচন করবে আমাদের সামনে ? আর কোন চমক অপেক্ষা করছে আমাদের সামনে, কে জানে ?
তথ্যসূত্রঃ
The Kilonova: A New Kind Of Cosmic Blast –www.popularmechaniscs.com
HUBBLE SEES THE FIREBALL FROM A ‘‘KILONOVA’’ – NASA .
খুব ভালো লিখা ……. আমার কাছে অনেক ভালো লাগছে interesting
univarsel is really mistrious…..
http://www.didi.com