কোয়ান্টাম কম্পিউটিং

কোয়ান্টাম প্রযুক্তির ঝুঁকি গুলি কি জানেন?

Share
Share

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরে যে প্রযুক্তি নিয়ে বিশ্বের বড় বড় দেশ এবং প্রতিষ্ঠানগুলি বিনিয়োগ করছে তা হল কোয়ান্টাম প্রযুক্তি।জাতিসংঘ ২০২৫ সালকে আন্তর্জাতিক কোয়ান্টাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর লক্ষ্য হল “কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের গুরুত্ব এবং এর ভবিষ্যতের প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা”।

কোয়ান্টাম প্রযুক্তি কি?

কোয়ান্টাম প্রযুক্তিটি একই সাথে খুব জটিল এবং অদ্ভুত। “কোয়ান্টাম” বলতে পদার্থ বিজ্ঞানীদের এনট্যাঙ্গলমেন্ট, আলো তরঙ্গ ও কণা উভয় রূপে বিদ্যমান থাকা, বা একটি বাক্সে বিড়াল যা একই সাথে জীবিত ও মৃত – এই ধারণাগুলির মধ্যেই সীমাব্ধ নয়। কোয়ান্টাম প্রযুক্তি সম্পন্ন কম্পিউারকে “কোয়ান্টাম কম্পিউটার” বলে যা একটি উন্নত কম্পিউটিং পদ্ধতি। এটি প্রচলিত ক্লাসিকাল কম্পিউটারের তুলনায় অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী এবং জটিল সমস্যাগুলি মুহুর্তের মধ্যেই সমাধান করতে পারে।  কোয়ান্টাম কম্পিউটিং একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি যা ভবিষ্যতে কম্পিউটিং জগতে বিপ্লব ঘটাতে পারে। তবে, এটি এখনও গবেষণা এবং উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে এবং এর পূর্ণ সম্ভাবনা বাস্তবায়নে আরও সময় লাগবে।

কোয়ান্টাম মেকানিক্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে কোয়ান্টাম কম্পিউটার, তথ্যের যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সেন্সর নির্মাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া অদূর ভবিষ্যতে এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) কে শক্তি যোগাতে পারে।

কোয়ান্টাম প্রযুক্তিটি নিয়ে সবাই এতটাই আশাবাদি যে, এই প্রযুক্তিটিতে কে এগিয়ে থাকবে তা নিয়ে চলছে ভীষণ প্রতিযোগিতা। কেননা ধারণা করা হচ্ছে, যারা এই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে তারাই বিশ্বকে নেতৃত্ব কিংবা নিয়ন্ত্রণ দিবে। তাই এখন বড় বড় প্রযুক্তির প্রতিষ্ঠান, প্রধান শক্তিধর দেশগুলি এবং শীর্ষ গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সবাই প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারযোগ্য কোয়ান্টাম সিস্টেম তৈরির প্রতিযোগিতায় রয়েছে।

কোয়ান্টাম প্রতিযোগিতা একটি দীর্ঘমেয়াদি ম্যারাথন দৌড়, নাকি স্বল্প মেয়াদি স্পিন্ট দৌড় হবে সে বিষয়ে মতামত ভিন্ন হলেও, এই কথা অনস্বীকার্য যে এটি আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি হতে যাচ্ছে।

অস্ট্রেলিয়ার গবেষনা সংস্থা CSIRO(The Commonwealth Scientific and Industrial Research Organisation) এর মতে ২০৪৫ সালের মধ্যে এই প্রযুক্তিটি অনুমানিক বার্ষিক ৬ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত রাজস্ব আনতে পারে এবং প্রায় ২০ হাজার লোকজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে। এর মধ্যে গত বছর ২০২৩ সালে অস্ট্রেলিয়া সরকার “বিশ্বব্যাপী কোয়ান্টাম শিল্পের একজন নেতা” হিসেবে গড়ে তুলতে তার জাতীয় কোয়ান্টাম কৌশল প্রণয়ন করেছে। পাশাপাশি অন্যান্য বৃহৎ দেশগুলিও কোয়ান্টাম প্রযুক্তির জন্য বিশাল পরিমানে বিনিয়োগ করছে।

অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে গত দুই বছরে ভিক্টোরিয়া সরকার কোয়ান্টাম স্টার্টআপগুলিতে ৩৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এই বছর ২০২৪ এর এপ্রিল মাসে, কমনওয়েলথ এবং কুইন্সল্যান্ড সরকার বিশ্বের প্রথম ইউটিলিটি-স্কেল কোয়ান্টাম কম্পিউটার নির্মাণের জন্য যৌথভাবে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এছাড়া সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্ট্রেলিয়ায় কোয়ান্টাম ইকোসিস্টেমের জন্য একটি জাতীয় হাব প্রতিষ্ঠার জন্য ১৮.৪ মিলিয়ন ডলারের ফেডারেল অনুদান দেওয়া হয়েছে।

কোয়ান্টাম প্রযুক্তির সম্ভাব্য ভূমিকা

এন্ট্যাঙ্গল্ড কোয়ান্টাম বিট (“কিউবিট”) এর উপর ভিত্তি করে, কোয়ান্টাম প্রযুক্তির তথ্যের আদান প্রদান ক্ষমতা বহুগুণ বাড়াবে, ইন্টারনেটের নেটওয়ার্ককে পরিবর্তন, এবং পণ্য, সম্পদ ও অর্থের প্রবাহ পূন:বন্টন করার সম্ভাবনা রয়েছে।

টেলিকমিউনিকেশন, ফার্মাসিউটিক্যাল, ব্যাংকিং এবং খনন – তথ্য এবং খনিজ উভয়ের – এর মতো বিভিন্ন বাণিজ্যিক শিল্প সবই রূপান্তরিত হবে।

কোয়ান্টাম প্রযুক্তি এবং নিরাপত্তা

কোয়ান্টাম প্রযুক্তি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে তা অনস্বিকার্য, তবে কোয়ান্টাম প্রযুক্তির প্রভাবে জাতীয় নিরাপত্তা কিরকম বিঘ্নিত হবে তা নিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকারকে বেশি চিন্তিত। এর মধ্যে কিছু ক্ষেত্রগুলি উল্লেখ করা হল:

  • কোয়ান্টাম প্রযুক্তির মাধ্যমে রাডার, কোড, ইন্টারনেট, সেন্সর এবং GPS সহ বিশ্বের সব সামরিক বাহিনী এবং প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রগুলির অনেক দ্রুত পরিবর্তন হবে। প্রযুক্তির এই প্রতিযোগীতায় প্রথমে পৌঁছাবে (কোয়ান্টাম “আছে” দেশগুলি) দেশগুলি বাকিদের জন্য (কোয়ান্টাম “নেই” দেশগুলি) ক্ষমতার নতুন অসাম্য এবং বিপদ সৃষ্টি করতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যেভাবে “যেসব দেশগুলির আণবিক বোমা” ছিল এবং যাদের ছিলনা এর মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট করেছিল, অনেকটা সেইরকম হতে পারে।
  • কোয়ান্টাম যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ নিরাপদ, হ্যাক করা যাবে না এমন যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে। এর ফলে অপরাধির হাতে এই প্রযুক্তি পৌছলে তা কোন দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে।উল্লেখ্য এমন একটি কোয়ান্টাম প্রযুক্তির নেটওয়ার্ক ইতিমধ্যেই চীনে প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার জুড়ে বেশ কয়েকটি প্রধান শহরকে সংযুক্ত করছে।
  • বর্তমানে যে তথ্যকে সুরক্ষার জন্য যে সকল এনক্রিপ্ট পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়, সেসব তথ্যগুলিকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হ্যাক করাতে পারবে এই কোয়ান্টাম প্রযুক্তি। প্রযুক্তিবিদরা এটিকে “Q-Day” হিসাবে সম্মোধন করে।
  • কোয়ান্টাম প্রযুক্তির মাধ্যমে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি হতে পারে তা দিয়ে কোন অস্ত্রের কর্মক্ষমতা উন্নত করতে পারে যা নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে। এমনকি মানুষের কোনও হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই নেটওয়ার্কযুক্ত যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোনের ঝাঁক পরিচালিত হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা।
  • কোয়ান্টাম সেন্সর এক বিশেষ ধরনের সেন্সর যা চৌম্বক এবং মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রকে অনেক তীক্ষ্ণ ভাবে পরিমাপ করতে পারে। এর ফলে মাটির নীচে এবং জলের নীচে ধাতু এবং বড় বস্তুগুলি সহজেই নির্ণয় করা। কোয়ান্টাম সেন্সিং প্রযুক্তির ফলে পানির নিচের সাবমেরিন কিংবা আকাশের বিমানকে আরো সহজে পর্যবেক্ষণ করা যাবে, যা কোন দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে।

এছাড়া আরো কিভাবে আমাদের জন্য হুমকি হতে পারে তা এখনই বর্ণনা করা কঠিন। তবে এই কথা অনস্বিকার্য যে এই কোয়ান্টাম প্রযুক্তি একদিকে যেভাবে সুফল নিয়ে আনতে পারে, অপরদিকে আমাদের জন্য ঝুঁকি তৈরী করতে পারে। তাই এই প্রযুক্তিটির ঝুঁকি সমন্ধে আমাদের ভালোমতন গবেষনা করে সচেতনতা প্রয়োজন।

তথ্যসূত্র:

১. https://www.sydney.edu.au/news-opinion/news/2024/07/19/quantum-technologies-time-to-discuss-risks-is-now-international-security-geopolitics-expert.html
২. https://au.news.yahoo.com/huge-race-develop-quantum-technologies-035522376.html
৩. https://www.innovationaus.com/authors/james-der-derian-and-stuart-rollo/
৪. https://cce.sydney.edu.au/course/TTQR
৫. https://projectqsydney.com/aicctp/grant-round-1/quantum-meta-ethics/

Share
Written by
ড. মশিউর রহমান -

ড. মশিউর রহমান বিজ্ঞানী.অর্গ এর cofounder যার যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৬ সনে। পেশাগত জীবনে কাজ করেছেন প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী ও শিক্ষক হিসাবে আমেরিকা, জাপান, বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরে। বর্তমানে তিনি কাজ করছেন ডিজিটাল হেল্থকেয়ারে যেখানে তার টিম তথ্যকে ব্যবহার করছেন বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবার জন্য। বিস্তারিত এর জন্য দেখুন: DrMashiur.com

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
GenZকৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকোয়ান্টাম কম্পিউটিংসাক্ষাৎকার

GenZ গবেষক মোহাম্মদ জুনায়েদ হাসান

নবীন বিজ্ঞানীদের সাক্ষাতকার পর্বে আমরা এইবার কথা বলেছি জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহাম্মদ...

কোয়ান্টাম কম্পিউটিংসাক্ষাৎকার

GenZ বিজ্ঞানী মো সাওমুন আজাদ

নবীন বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের ধারাবাহিকতায় এইবার আমরা সাক্ষাৎকার নিয়েছি তরুণ বিজ্ঞানী সুমন আজাদের।...

কোয়ান্টাম কম্পিউটিংসাক্ষাৎকার

GenZ নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানী আরমান সৈকত

নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যে শুধু আমাদের সমাজকে পরিবর্তন করার জন্য কাজ করছে...

কোয়ান্টাম কম্পিউটিং

কোয়ান্টাম কম্পিউটিং: ভবিষ্যতের কম্পিউটার

কোয়ান্টাম কম্পিউটিং হল গণনার জগতে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন। এটি এক নতুন...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.